সিলেটের মেয়ে তানিয়া আক্তার (ছদ্মনাম)। সতের বছর বয়সী এই কিশোরী একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছেন। পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে একটি স্মার্ট মোবাইল ফোন দেয়া হয়। সেই ফোনে ফেসবুক আইডি খোলেন তানিয়া।
বছর খানেক আগে সেই আইডিতে পরিচয় হয় এনামুল হক (৩২) নামের যুবকের সঙ্গে। চতুর এনামুল নিজেকে উচ্চ শিক্ষিত ও বড় চাকরি করে বলে জানান তানিয়াকে। ফেসবুক মেসেঞ্জারে তাদের চ্যাটিংয়ে কথা হতো। কিছুদিন কথা বলার পর দু’জনের মধ্যে সখ্যতা বাড়ে।
এক সময় তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাঝেমধ্যে অডিও এবং ভিডিও কলেও কথা হতো। এনামুল প্রায়ই তানিয়াকে ভিডিও কলে নগ্নভাবে আসার অনুরোধ করতেন। রাজি হতেন না তানিয়া। রাগ করতেন এনামুল। পরে প্রেমিককে খুশি রাখতে এনামুলের কথামতোই ভিডিও কলে নিজেকে নগ্নভাবে উপস্থাপন করেন তানিয়া। এনামুল কৌশলে ভিডিও কলে স্ক্রিনশট দিয়ে তানিয়ার নগ্ন ছবি সংরক্ষণ করে রাখতেন।
প্রেমিক এনামুলের নানারকম ইচ্ছা পূরণ আর ব্ল্যাকমেইলে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন তানিয়া। এক পর্যায়ে এনামুলের ফেসবুক আইডি ব্লক করে দেন। এতে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এনামুল। আগে থেকে তানিয়ার ব্যবহার করা ফেসবুক আইডি ছিল তার কাছে। সে নগ্ন ছবিগুলো তানিয়ার আইডিতে পোস্ট করেন।
কিছুক্ষণ পর আবার ডিলেট করে দেন। সেই পোস্ট তানিয়ার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনরা দেখেন। পরে তাকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানান। বেপরোয়া এনামুল পরে তানিয়ার ফেসবুক আইডির প্রোফাইলে তার বড় বোনের ছবি জুড়ে দিয়ে আবার সেই নগ্ন ছবি আপলোড করেন।
নগ্ন ছবি নিজের হেফাজতে রেখে থেমে যাননি এনামুল। ২০২১ সালের ২৭শে জুলাই তানিয়ার হোয়াটঅ্যাপ নম্বরে সেগুলো পাঠান এনামুল। নিজের নগ্ন ছবি প্রেমিকের কাছ থেকে আসায় হতভম্ব হয়ে পড়েন তানিয়া। তারপর থেকে ব্ল্যাকমেইল শুরু করেন এনামুল।
এর আগে থেকেই তানিয়া নগ্ন হয়ে ভিডিও কলে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যেটি ভালোভাবে নেননি এনামুল। আর সেই ক্ষোভ থেকেই ব্ল্যাকমেইল শুরু করেন এনামুল। ভয়ভীতি দেখিয়ে তানিয়াকে প্রায়ই ভিডিও কলে নগ্নভাবে আসার জন্য বলতেন। রাজি হতেন না তানিয়া। কিন্তু এনামুল নগ্ন ছবি ইন্টারনেট ও তার আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে নগ্ন হতে বাধ্য করতেন।
প্রেমিকের ব্ল্যাকমেইলের ভার একাই বয়ে যাচ্ছিলেন তানিয়া। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়াতে তার বড় বোনের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করেন। পরিবারের সদস্যরা এনামুলকে বুঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সে তাতে রাজি হয়নি। তানিয়া ও তার পরিবার সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছিলেন। কারণ, ঘটনাটি অনেকেই জেনে যাচ্ছিলেন। তানিয়াও এরকম পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন।
চলতি বছরের ২রা ফেব্রুয়ারি মুগদা থানায় একটি মামলা করেন তানিয়ার বড় বোন। মামলার তদন্ত আসে ডিবি সাইবারের কাছে। পরে মুগদা থানার পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় গত শনিবার গাজীপুর মেট্রোপলিটন কোনাবাড়ী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে এনামুলকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের সোশ্যাল মিডিয়া ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারীদের আরও সচেতন হতে হবে। অপরিচিত কাউকে ফ্রেন্ড লিস্টে নিয়ে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া যাবে না। আর ঘনিষ্ঠ হলেও ভিডিও কলে খোলামেলাভাবে আসা যাবে না।
কারণ এগুলো অনেক সময় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায় বা দাঁড়াতে পারে। এনামুল ওই কিশোরীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে ব্ল্যাকমেইল করেছেন। আর প্রেমিককে খুশি রাখতেই ভিডিও কলে এসেছিলেন। কিন্তু এনামুল সেসব দৃশ্য ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করার পুঁজি সংগ্রহ করেন।তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা কারো সঙ্গে ঘটলে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরামর্শ নিতে হবে। না হলে এ ধরনের সাইবার অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। এসব ঘটনা অনেক নারীর জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনবে।
এনামুল লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার হররাম গ্রামের বাসিন্দা। ওই এলাকার আ. রশিদ ও আনোয়ারা খাতুনের সন্তান। তানিয়াকে উচ্চ শিক্ষিত ও বড় চাকরি করে বলে পরিচয় দিলেও প্রকৃত পক্ষে এনামুল এসএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। একটি পোশাক কারখানায় অল্প বেতনে চাকরি করেন।