প্রায় ৫১০০ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক ঋণ মাথায় নিয়ে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে শ্রীলঙ্কা। তারা বলেছে, ঋণদাতাদের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। সংকটে জর্জরিত দেশটি মঙ্গলবার এ ঘোষণা দিয়েছে। পক্ষান্তরে বৈদেশিক রিজার্ভে তাদের জমা আছে মাত্র ২২২ কোটি ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পি নন্দলাল বীরাসিঙ্গে বলেছেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা চ্যালেঞ্জিং ও অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে উত্তম পন্থা হতে পারে ঋণ কাঠামো পুনর্গঠন ও কঠোরভাবে ঋণখেলাপি হওয়া এড়ানো। ওয়াশিংটন পোস্টে দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ সাময়িক স্থগিত ঘোষণা দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এটা তাদের একটি ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ।
ওয়াশিংটন পোস্ট আরও লিখেছে, ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হয় শ্রীলঙ্কা। তারপর থেকে এবারই প্রথমবার তারা ঋণখেলাপি বা দেউলিয়া হওয়ার ঘোষণা দিলো। দেশটি সম্প্রতি জ্বালানি, খাদ্য, মেডিকেল সরঞ্জামাদি আমদানিতে লড়াই করছে। কয়েক মাসে এসব খাতে সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সঙ্গে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নাড়া লেগেছে।
উপকূলীয় রাজধানী কলম্বো থেকে কেন্দ্রীয় উঁচুভূমি পর্যন্ত হাজার হাজার ক্ষুব্ধ মানুষ সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছেন। তাদের দাবি প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসেকে পদত্যাগ করতে হবে। তার পরিবার দুই দশক ধরে এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে আছে।
এর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে যে, সরকার কী কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। তারা তীব্র মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে লড়াই করছে। সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কিছুদিন ধরে চলছে জোর আন্দোলন। এতে দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের এই দ্বীপরাষ্ট্রে মানবিক বিপর্যয় ঘনিয়ে আসছে।
দেশটি গৃহযুদ্ধের দিতে ধাবিত হচ্ছে বলে আগেই সতর্কতা দেয়া হয়েছে। চিকিৎসরা বলেছেন, করোনা ভাইরাস সংকট সময়ের চেয়ে বেশি মানুষ মারা যেতে পারেন এতে। এরই মধ্যে খাদ্যের দাম বেড়েছে শতকরা ৩০ ভাগ। ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাচ্ছে লোকজন।
প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে, তার ভাই ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসে সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আগামী সপ্তাহে ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের সঙ্গে একটি বেইলআউট বা সংকট উত্তরণে অর্থায়ন বিষয়ক একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে সরকারের। এরই মধ্যে তীব্র জনরোষের ফলে মন্ত্রিপরিষদে রদবদল করেছে তারা। ২৪ জন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন।
রাজাপাকসের অর্থনৈতিক টিম বলেছে, তারা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ জন্য সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। শ্রীলঙ্কান রুপির অবমূল্যায়ন করা হয়েছে- যাতে আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা আশ্বস্ত হন যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ন্ত্রণে সময় দেয়া হয়, তাহলে তারা প্রদেয় অর্থ পরিশোধে সক্ষম হবে। বর্তমানে সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কার ৫১০০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ আছে। এই বছরে এর বিপরীতে ৭০০ কোটি ডলার পেমেন্ট ফেরত দেয়ার কথা দাতাদের কাছে।
কলম্বোতে নিরপেক্ষ থিংকট্যাংক এডভোকেটা’র প্রধান মুর্তাজা জাফেরজি বলেন, দেশের অর্থনীতির অবনমন বা নিম্নমুখী হচ্ছে এ কথা বছরের পর বছর ধরে প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন রাজাপাকসে সরকার। ২০১৯ সালে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, রাজাপাকসে বড় অঙ্কের ট্যাক্স কর্তন করেন।
যখন অনেক বছরের মধ্যে শ্রীলঙ্কার পর্যটননির্ভর অর্থনীতির ফলে বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে তখন এসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ সময়ে করোনাভাইরাস মহামারিতে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় উবে গিয়েছে। শ্রীলঙ্কার ডলারের রিজার্ভ যখন শুকিয়ে যাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি শক্ত কামড় বসিয়েছে, তখন জনগণের চামড়া পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। কারণ, খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৩০ ভাগ।
গ্যাস স্টেশনে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমাণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। সম্প্রতি অনেক কর্মকর্তা সতর্কতা দিয়ে বলেছেন, দেশটিতে মানুষজন গণহারে অনাহারে থাকার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মুর্তাজা জাফেরজি বলেন, আমাদের রিজার্ভ একেবারে ফুরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত জনগণ ত্যাগ স্বীকার করেছে। এখন তারা ভয়াবহ এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি রাজাপাকসে একটি অর্থনৈতিক টিম প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা আক্ষরিক অর্থে সমস্যাকে আরও বড় করেছে।
এ অবস্থায় দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, একদিকে কোভিড-১৯ মহামারি, অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ ও তার ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থানকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এর ফলে বাধ্যতামূলক স্বাভাবিক সার্ভিসিং সেবা অব্যাহত রাখা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকার ব্যতিক্রমী সব পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে যদি আরও বিলম্ব করা হয় তাহলে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি স্থায়ীভাবে ক্ষতির ঝুঁকিতে পড়বে।
গোটাবাইয়া রাজাপাকসের ছোট ভাই বাসিল রাজাপাকসে এর আগে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে ৪ঠা এপ্রিল তাকে এই পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন রাজাপাকসে। তিনজন প্রশিক্ষিত অর্থনীতিবিদকে তিন দিন পরে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা টিমে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি সম্প্রতি সুদের হার অনেক বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে সরকার। নিজের ভাইকে সরিয়ে দিয়ে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আলি সাবরিকে নিয়োগ দিয়েছেন রাজাপাকসে।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা দৃশ্যত বিরোধীদের নজর কাড়েনি। তারা দাবি করছেন রাজাপাকসের প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমতা কেড়ে নিতে হবে। অথবা রাজাপাকসে ও তার পরিবারের সদস্যরা- যাদের আছে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমর্থন, তাদের সবাইকে একসঙ্গে রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিতে হবে।
দেশটিতে এই অচলাবস্থা এক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে কে ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার নেতৃত্ব দেবেন। এর ফলে আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের অস্থির করে তুলতে পারে। রাজাপাকসেরা ক্ষমতা তবু আঁকড়ে ধরে আছেন। এতে বিক্ষোভকারীদের উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিক্ষোভকারীরা কলম্বোর কেন্দ্রীয় অংশে প্রেসিডেন্টের অফিসের সামনে সার্বক্ষণিক প্রতিবাদ করছেন, ক্যাম্প করছেন। তারা রাজাপাকসেকে বিদায় নেয়ার স্লোগান দিচ্ছেন। একই সঙ্গে যে অর্থ তিনি চুরি করেছেন তা ফেরত দেয়ার দাবি তোলা হচ্ছে।
ঋণ খেলাপি ঘোষণা দেয়ার আগে আলি সাবরি বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না যে- ভয়াবহ খাদ্য ও ওষুধের সংকটে পড়বে শ্রীলঙ্কা। এক্ষেত্রে সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কথা বলছে। কথা বলছে ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে।
এই সংকটে জরুরি সরবরাহ দেয়া নিয়ে তাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে সরকারের। আলি সাবরি আরও বলেছেন, বিভিন্ন দেশের সরকার সহ আন্তর্জাতিক দাতাদের সঙ্গে সংলাপ চালানো হচ্ছে। তাদেরকে অনুরোধ করা হচ্ছে ঋণের অর্থ পরিশোধে সময় বাড়াতে। প্রস্তাব করা হচ্ছে খাদ্য ও ওষুধের সংকট আরও তীব্র হলে এক্ষেত্রে সহায়তা করতে।
এর আগে অনেক রিপোর্টে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কায় এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। চিকিৎসকদের সংগঠন থেকে বলা হয়েছে, ওষুধ ও সরঞ্জামের সংকট এমন অবস্থায় থাকলে করোনাভাইরাসে যে পরিমাণ মানুষ মারা গেছেন, তারচেয়ে বেশি মানুষ মারা যাবেন শ্রীলঙ্কায়।