রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ ডায়রিয়া ও কলেরার প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এর প্রধান কারণ পানিদূষণ। গত সোয়া তিন মাস দেশে ৫ লাখের কাছাকাছি মানুষ ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন। ঢাকার নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা দিয়েছে।
এসব এলাকার বয়স্ক মানুষই বেশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। মোট রোগীর ৪০ শতাংশের মতো তীব্র পানিশূন্যতা নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। তাদের সুস্থ হতে যেমন সময় লাগছে, তেমনি মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। হাসপাতালে আসা এসব রোগীর বেশির ভাগই অভিযোগ, ওয়াসার পানি পান করেই তাদের সমস্যা হয়েছে।
আইসিডিডিআর,বি’র চিকিৎসকরা বলেন, মূলত কয়েকটা এলাকা থেকেই রোগী বেশি আসছে। সব জায়গায় দেখা যাচ্ছে পানির সমস্যা। পানিতে গন্ধ। অনেক কারণে পানি দূষিত হয়। রোগীদের বেশির ভাগই বলেছেন, তাদের পানি খেয়েই সমস্যা হয়েছে। অনেকে বলেছেন, তারা ওয়াসার পানি ফুটিয়ে খাননি।
আক্রান্তরা পানি ফুটিয়ে পান করেননি। অনেকে এমনও বলেছেন, পানি ফুটালেও দুর্গন্ধ যাচ্ছে না। রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) কলেরা হাসপাতালে আসা রোগী ও চিকিৎসকরা এমনটাই জানিয়েছেন।
আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালের প্রধান ডা. বাহারুল আলম এ ব্যাপারে বলেন, ডায়রিয়া একটি পানিবাহিত রোগ। ইনজেকশন বা রক্তের মাধ্যমে রোগটির জীবাণু শরীরে যাবে না। এটা পানির মাধ্যমে মুখ দিয়েই শরীরে যাবে। যেকোনো উপায়ে তারা দূষিত পানি খেয়েছেন। সেটা ওয়াসারও হতে পারে বা অন্য কোনো কারণেও দূষিত হতে পারে।
মা ও মেয়ে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন আইসিডিডিআর,বি কলেরা হাসপাতালটিতে। ৪ বছরের শিশুকন্যার পাশের শয্যায় মা সুইটি আক্তারও ভর্তি ছিলেন। শিশুটি চুপচাপ থাকলেও ২৬ বছর বয়সী মা পেটের ব্যথায় কিছুক্ষণ পরপর চিৎকার করে উঠছিলেন।
একই পরিবারের এই দুই সদস্য ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন যাত্রাবাড়ীর মীরহাজারীবাগ এলাকায়। হাসপাতালে তাদের শয্যার পাশে উপস্থিত ছিলেন এমন এক স্বজন জানান, পানির কারণে তাদের ডায়রিয়া হয়ে থাকতে পারে। তারা বেশির ভাগ সময় ফুটানো পানি পান করেন না। প্রায় সময়ে লাইনের পানিতেও দুর্গন্ধ আসে।
ডা. বাহারুল আলম বলেন, তীব্র পানিশূন্যতা নিয়ে রোগী বেশি আসছেন। তাৎক্ষণিকভাবে তার পানিশূন্যতা দূর না করি, সে মারা যাবে। মোট রোগীর ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ তীব্র পানিশূন্যতা নিয়ে আসছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডায়রিয়া রোগীদের তিনভাগে ভাগ করে-তীব্র, আংশিক ও কোনো ধরনের পানিশূন্যতা নেই। তাদের মধ্যে তীব্র পানিশূন্যতার রোগীরাই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের সেরে উঠতে সময় লাগে। তাদের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি।
গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, পানিদূষণের কারণেই রাজধানীতে ডায়রিয়া বেড়েছে। তিনি বলেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হঠাৎ ডায়রিয়া ও কলেরার প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এর প্রধান কারণ পানিদূষণ। এ অবস্থায় সবাইকে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে দেশের পানি, বায়ু ও মাটিকে ভালো রাখতে হবে।
কলেরা হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, শনির আখড়া ও দক্ষিণখান এলাকা থেকে রোগী বেশি আসছেন। প্রায় সবারই অভিযোগ, তারা বাসায় যে পানি পান করছেন, সেখান থেকেই সমস্যা হয়েছে। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর ও মিরপুর থেকেও রোগী বেশি আসছেন।
৭ই এপ্রিল রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) এক সেমিনারে ‘ডক্টরস প্ল্যাটফরম ফর পিপল্স হেল্থ’- নামের একটি সংগঠন জানিয়েছে, দেশে প্রতি বছর ডায়রিয়ায় প্রায় দুই লাখ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে আবার চলতি বছর (২০২২ সাল) ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও বেড়েছে। শুধু তাই নয়, জনসংখ্যার ৩৮ শতাংশ মানুষ দূষিত উৎস থেকে পানি পান করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাস্তার খাবার, বাসি-পচা খাবার খেলেও ডায়রিয়া হতে পারে। তবে ডায়রিয়া হওয়ার মূল কারণ দূষিত পানি। খাবার পানিসহ নিত্য ব্যবহার্য পানিও হতে হবে বিশুদ্ধ এবং নিরাপদ। কিন্তু কোনোভাবে যদি খাবার পানির লাইনের সঙ্গে স্যুয়ারেজ লাইনের সংযোগ ঘটে যায় তাহলে পানি হয়ে পড়ে দূষিত।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঢাকা শহরে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ চলছে। রাস্তাঘাট খোঁড়া হচ্ছে। সেখানে ওয়াসার পানির পাইপ ফেটে গিয়ে স্যুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে মিলে পানি আর বিশুদ্ধ থাকছে না। যার কারণে ঢাকার ভেতরে ডায়রিয়ার রোগী বাড়ছে।
এদিকে, গত ৫ই এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংলাপে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেছেন, ৫ থেকে ১০ শতাংশ জায়গায় ওয়াসার পাইপ ফাটা থাকে। তবে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা ঠিক করে দেন দাবি করে তিনি বলেন, কিছু জায়গায় সমস্যা হয়। নয়াপল্টনে তার নিজের বাসার পানিতেও গন্ধ আছে বলে উল্লেখ করেন। এ সময় তিনি নগরবাসীকে পানি ফুটিয়ে পান করার পরামর্শ দেন।