সৌদি আরব থেকে বোনের মৃতদেহ দেশে আনার জন্য সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করেছেন ভাই আক্কাস মিয়া। আজ মঙ্গলবার করা আবেদনে জানিয়েছেন, বোনের লাশ পেতে দালাল, রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, কোনো লাভ হয়নি। বিমানবন্দরে লাশ এলে সেটি গ্রহণের জন্য আক্কাস মিয়ার মুঠোফোন নম্বর দিয়ে রেখেছেন। বোন মারা গেছেন ফেব্রুয়ারি মাসে, ভাই এখনো জানেন না তাঁর লাশটি কবে দেশে আসবে।
আক্কাস মিয়া বললেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাসেই আমার বোনের দেশে আসনের কথা ছিল। দালাল কয়, বোন নাকি আত্মহত্যা করছে। যে মানুষটা দেশে আসনের খুশিতে ছিল, সে ক্যান আত্মহত্যা করব?’আজ আক্কাস মিয়া ও শরিফুল ইসলাম বোনের লাশ দেশে আনতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান। চার ভাই–বোনের মধ্যে ফাতেমাই সবচেয়ে বেশি সুস্থ ছিলেন বলে জানালেন দুই ভাই।
লুঙ্গি পরা, মলিন শার্ট গায়ে এই ভাই আক্ষেপ করে বললেন, ‘বোনের লাশ আনার জন্য কত জায়গায় যে দৌড়াইতাছি, কিছুই লাভ হইতেছে না।’বোনের ছবি আছে কি না, জানতে চাইতে শার্টের পকেটে হাত দিয়ে পরম যত্নে বোনের একটি ছবি বের করে দেখালেন।
জানালেন ২০১৯ সালে সৌদি আরবে যাওয়ার আগে পাসপোর্ট সাইজের ছবিটি তুলেছিলেন বোন। ৩৩ বছর বয়সী বোনের নাম ফাতেমা আক্তার। গত ৩ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবে মৃত্যু হয়েছে তাঁর। আর এ খবরটা ভাই আক্কাস মিয়া ও শরিফুল ইসলাম জানতে পেরেছেন প্রায় ১১ দিন পর।
তারা বললেন, ঠান্ডা মেজাজের বোনটি আত্মহত্যা করেছে—এটা তাঁরা মানতে পারছেন না।শরিফুল ইসলাম জানান, ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফোনে ফাতেমার সঙ্গে কথা হয়। তখন ফাতেমা জানিয়েছিলেন, মালিকের কাছে দেশে যাওয়ার টিকিট চেয়েছেন বলে তিনি খুব রাগারাগি করছেন। মালিকের বউ তাঁকে মারতে আসছেন জানিয়ে পরে আবার কথা বলবেন বলে ফোনের লাইন কেটে দিয়েছিলেন।
দুই ভাই জানালেন, মাস ছয়েক আগেও ভিডিও কলে বোন তাঁর ভাঙা আঙুল দেখিয়ে জানিয়েছিলেন, মালিকের বউ মেরেছেন। খেতে চাইলে খাবার না দেওয়াসহ অন্যান্য নির্যাতনের কথাও জানিয়েছিলেন ফাতেমা। তাই ফাতেমা আত্মহত্যা করেছেন—এটা তাঁরা মানতে নারাজ।
শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘কী হইছে বোন, কান্দো ক্যান—ফোনেই জানতে চাইছিলাম। বোন তাড়াতাড়ি ফোনের লাইন কেটে দেয়। তারপর কতবার রিং হইছে, বোন আর ফোন ধরে নাই।’স্থানীয় দালালের কাছে বোনের খবর জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যেতে থাকেন। বোন জীবিত না মৃত—এ খবর জানতে চেয়ে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর মডেল থানায় দালালের নামে সাধারণ ডায়েরিও করেছিলেন দুই ভাই।
এরপর গ্রামের মেম্বারসহ মুরব্বিদের নিয়ে দালালের বাড়িতে গেলে চাপের মুখে দালাল বলেন, ফাতেমা মারা গেছেন। সৌদি মালিক টিকিট হাতে নিয়ে ফাতেমাকে ডাকতে গিয়ে দেখেন দরজা বন্ধ। পরে বন্ধ দরজা খুলে ঘরে ঢুকে দেখেন ফাতেমা আত্মহত্যা করেছেন।
দালালের কাছ থেকে পাওয়া বিভিন্ন কাগজপত্রেও ফাতেমা মারা গেছেন বলে উল্লেখ আছে। সৌদি আরব থেকে আরবিতে পাঠানো প্রাথমিক ফরেনসিক মেডিকেল রিপোর্টটি নিউ আল-মদিনা ট্রান্সলেশন সেন্টার থেকে অনুবাদ করিয়েছেন দুই ভাই। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, ফাতেমার ঘাড়ের ওপরের দিক রক্তাক্ত ছিল, সেখানে রক্ত গড়িয়ে যাওয়ার প্রমাণ ছিল। এ ছাড়া তাঁর গায়ে আর কোনো আঘাতের চিহ্ন ছিল না। অনুবাদ করা প্রতিবেদন বলছে, ফাতেমাকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় নেওয়া হয়েছিল।
ফাতেমার ভাই শরিফুল ইসলাম দরজির কাজ করেন। লেবাননে ছিলেন ছয় বছর। আরবি ভাষায় কথা বলতে পারেন। তিনি জানালেন, ফাতেমার মালিকের সঙ্গে আগে কথা বলে তাঁকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন, তখন তিনি খারাপ ব্যবহার করেছিলেন।
অপশন ম্যানপাওয়ার সার্ভিস নামের রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ফাতেমা গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। তাঁর দুই ভাই জানালেন, রাজধানীতে এই এজেন্সির অফিস, তাঁরা আজ পর্যন্ত মালিকের চেহারাও দেখেননি। অভ্যর্থনা কক্ষে কথা বলতে হয়, ফাতেমার লাশ দেশে আনার বিষয়ে পরে সব জানাবে বললেও ওই অফিস থেকে আর কিছু জানানো হয়নি।
আর দালাল হিসেবে যিনি কাজ করেছেন, তিনি ফাতেমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এর আগে ফাতেমা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, সে কথা জানিয়ে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বললে বা এখন তাঁর লাশ দেশে আনার কথা বললে ওই দালাল খারাপ ব্যবহার করেন। তাঁর ভাষ্যমতে, এটা কি মামার বাড়ির আবদার যে চাইলেও লাশ দেশে এনে দিতে পারবেন তিনি।
দুই ভাই তাঁদের কাজ ফেলে একবার সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, আরেকবার ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড, স্থানীয় ব্র্যাকের অফিসসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরছেন বোনের লাশ দেশে ফেরত আনার জন্য। দুই ভাই বললেন, বৃদ্ধ মা–বাবা বাড়িতে কান্নাকাটি করছেন। বোনের লাশটা দেখাতে পারলেও তাঁরা একটু শান্তি পেতেন।
ফাতেমার ভাই শরিফুল ইসলাম জানালেন, তাঁরা বোনের লাশ আনার জন্য প্রথমে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে আবেদন করেছিলেন। সেখান থেকে কোনো উত্তর পাননি। পরে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করলেন। এর আগে এখান থেকে তাঁদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেননি।
স্থানীয় ব্র্যাক অফিসের মাধ্যমে ফাতেমার দুই ভাই আজ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে বোনের মরদেহ দেশে আনার আবেদন জানিয়েছেন। জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের শ্রমকল্যাণ উইংয়ের কাউন্সেলর (শ্রম) মো. আমিনুল ইসলাম গত ৩ মার্চ ফাতেমার মৃতদেহ বাংলাদেশে পাঠানো অথবা স্থানীয়ভাবে দাফনের জন্য উত্তরাধিকারীদের মতামত জানতে চেয়ে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক বরাবর একটি চিঠি দিয়েছিলেন।
তাতে থানা ও হাসপাতাল সূত্রের বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ফাতেমা ৩ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন। এই চিঠিতেই মৃতদেহ শনাক্তকারী ব্যক্তির নাম ও যোগাযোগের নম্বরসহ ওয়ারিশদের মতামত যৌক্তিক সময়ে পাওয়া না গেলে করোনায় সৃষ্ট সংকটে সৌদি কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে স্থানীয়ভাবে লাশ দাফন করবে বলেও জানিয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, সৌদি আরব থেকে লাশ আনতে সময় একটু বেশি লাগে, সেখানকার ১৪টি বিভাগের অনুমতি নেওয়াসহ বিভিন্ন জটিলতা পোহাতে হয়। বৈধ শ্রমিকের লাশ দেশে আনার পর লাশ দাফনের জন্য ৩৫ হাজার টাকা এবং পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়।