নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলঙ্কা
নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে শ্রীলঙ্কা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর এতো দুরাবস্থায় কখনো পড়তে হয়নি দেশটিকে। গত কয়েক বছর ধরেই অর্থনৈতিক সংকট ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছিল। সংকটের শুরুতে তাদের বাংলাদেশ থেকেও ২৫ কোটি ডলার ঋণ নিতে হয়েছিল। এটি ছিল কোনো দেশের জন্য দেয়া বাংলাদেশের প্রথম ঋণ। অথচ এক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার সবথেকে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোর একটি ছিল শ্রীলঙ্কা। তারপরেও এখন তাদের কেনো এমন অবস্থা?
কোভিড-১৯ মহামারির আগে থেকেই শ্রীলঙ্কার এই সংকট শুরু হয়। তবে মহামারির সময় লাগাতার লকডাউন অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলে। পাশাপাশি গত দুই বছরে দেশটির ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ৭০ শতাংশ কমেছে, রিজার্ভে আছে মাত্র ২.৩১ বিলিয়ন ডলার। ফলে খাদ্য ও তেলসহ প্রয়োজনীয় আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে দেশটির।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি পর্যটনের ওপরে ব্যাপক নির্ভরশীল। দেশটির অর্থনীতির ১২ শতাংশই আসতো পর্যটন থেকে, যা মহামারির কারণে প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। আর এতে বিদেশী মুদ্রার প্রবাহেও ভাটা পড়েছে। বিদেশে যেসব শ্রীলঙ্কান কাজ করতেন তারাও দেশে অর্থ পাঠানো কমিয়ে দিয়েছে। সব কিছুই একটু একটু করে শ্রীলঙ্কাকে এই খাঁদে ফেলেছে।
বিশ্লেষকরা যদিও কোনো নির্দিষ্ট কারণকে শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির জন্য দোষারোপ করছেন না। বলা হচ্ছে, এর পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের বহুদিনের অব্যবস্থাপনা, ভুল সময়ে ট্যাক্স হ্রাস এবং কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাব।এছাড়া, বিদেশী ঋণের বিশাল স্তুপ, দফায় দফায় লকডাউন, মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানী তেলের সংকট এবং বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ না থাকার মতো বিষয়গুলোও এই সংকটকে গভীর করেছে।
আস্তে আস্তে থেমে গেছে শ্রীলঙ্কার প্রবৃদ্ধি।ভারত, চীন ও বাংলাদেশের মতো দেশ শ্রীলঙ্কাকে সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকেও সাহায্য চেয়েছে দেশটি। কিন্তু এই সংকট এতটাই প্রকট যে এখান থেকে উঠে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা একদমই দেখছেন না পর্যবেক্ষকরা।
এই বছর দেশটিকে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হবে অথচ ফেব্রুয়ারির হিসেবে রিজার্ভে আছে মাত্র ২.৩১ বিলিয়ন ডলার। কলোম্বোভিত্তিক থিংক ট্যাংক অ্যাডভোকেট ইনস্টিটিউটের শীর্ষ কর্মকর্তা ধননাথ ফার্নান্দো রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, শ্রীলঙ্কার এই সংকটের কারণ পণ্যের ঘাটতি নয় বরং ডলারের ঘাটতি। দেশটির সরকার অর্থ জোগাড়ের জন্য ২০০৭ সাল থেকে সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করে।
আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে এ ধরণের বন্ড বিক্রি করে অর্থের জোগান দেয়া হয়। শ্রীলংকা সেটাই করেছে। কিন্তু এখন এই অর্থ পরিশোধ করতে গিয়েই বিপাকে পড়ছে শ্রীলঙ্কা। শুধু ওই বন্ড বাবদ শ্রীলংকার ঋণ রয়েছে এখন বারো বিলিয়ন ডলারের বেশি। এ বছর যে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে শ্রীলঙ্কাকে তার এক বিলিয়ন ডলার এই সার্বভৌম বন্ডের। এগুলো আগামী জুলাই মাসে পরিপক্ক হবে।
শ্রীলঙ্কার এই সংকটের জন্য পর্যবেক্ষকদের একাংশ দেশটির প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারকে দায়ী করছেন। সাধারণ মানুষের ক্ষোভও গিয়ে পড়েছে তাদের ওপরে। সর্বশেষ প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ এবং পরবর্তীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ তাই প্রমাণ করে। রাজাপাকসের পরিবার গত কয়েক দশক ধরেই শ্রীলঙ্কার রাজনীতির কলকাঠি নিয়ন্ত্রণ করছে।
২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট হন গোটাবাইয়া রাজাপাকসে আর প্রধানমন্ত্রী হন তার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে। শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে তার আরেক ভাই। মন্ত্রীসভার সদস্য আরেক ভাই চামাল রাজাপাকসেও। শুধু ভাইয়েরাই নয়, ভাইদের দুই ছেলে নামাল ও শশীন্দ্র রাজাপাকসেও রয়েছেন মন্ত্রীসভায়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম দাপট দেখিয়ে আসছে শ্রীলংকার রাজাপাকসে পরিবার।
অর্থনৈতিক সংকটে লাখ লাখ শ্রীলঙ্কান চাকরি হারিয়েছেন। প্রায় প্রতি পরিবারেই কেউ না কেউ চাকরি হারিয়েছে। পরিবারগুলোর আয় কমেছে। ফলে বেড়েছে দারিদ্র্য। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ২০২০ সালে শ্রীলঙ্কায় প্রতিদিন ৩.২ ডলারের কম আয় করা মানুষের সংখ্যা বেড়ে ১১.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যা তার আগের বছর ছিল ৯.২ শতাংশ।
নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন ৫ লাখেরও বেশি মানুষ। এছাড়া ৫০ লাখ পরিবারকে অর্থনৈতিক দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে সরকার। লকডাউনের সময় তাদেরকে ৫ হাজার রূপি করে সাহায্য দেয়া হয়েছিল। যদিও এই সাহায্যে তাদের দুর্দশা তেমন কিছু লাঘব হয়নি।
২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসে অর্থনীতির চেহারা পাল্টে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রাজাপাকসে। এ জন্য তিনি দেশটির মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে অর্ধেকে নিয়ে আসেন। তার বিশ্বাস ছিল, এটি অর্থনীতির গতিকে ত্বরান্বিত করবে। কিন্তু এ কারণে রাষ্ট্র বিলিয়ন বিলিয়ন রূপি হারাতে শুরু করে। ফলে ঋণ পরিশোধ আরও কঠিন হয়ে যায় সরকারের জন্য। সর্বশেষ ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ যেনো শ্রীলঙ্কার দুর্ভোগকে কানায় কানায় পূর্ণ করলো।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় দেশটির অর্থনীতিও অস্থিতিশীল হতে শুরু করে। মানুষের মধ্যে হতাশা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। তেলের অভাবে প্রতিদিন ১০ ঘন্টার বেশি বিদ্যুতহীন থাকতে হচ্ছে দেশটিকে। মার্চ মাসের শুরু থেকেই দৈনিক ৭ ঘণ্টা করে বিদ্যুৎহীন থাকতে হয়েছে শ্রীলঙ্কানদের।
দেশটির বেশিরভাগ বিদ্যুৎ আসে কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো থেকে। কিন্তু যথেষ্ট রিজার্ভ না থাকায় এগুলোর আমদানি প্রায় বন্ধ শ্রীলঙ্কায়। দেশটির বাসিন্দাদের সামনে দৈনিক ১৬ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎহীন থাকতে হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রাজাপাকসের পরিবারের উত্থান হয় দাদা ডন ডেভিড রাজাপাকসের হাত ধরে। তিনি ছিলেন প্রাচীন বৃটিশ শাসনের গুচ্ছগ্রামের গ্রামপ্রধান। তার ছেলে ডন অলউইন রাজাপাকসে। তিনি ছিলেন শ্রীলংকার কৃষিমন্ত্রী। ডেপুটি স্পিকার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। দেশটির ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল শ্রীলংকান ফ্রিডম পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি।
অলউইনের বড় ভাই ডন ম্যাথিউ রাজাপাকসেও শ্রীলংকায় দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করেছেন। বাবার হাত ধরে ছেলে এরপর ভাইয়ের সঙ্গে ভাই মিলে শাসন করছে শ্রীলঙ্কা। চাচার পেছনে ভাতিজারাও এখন দেশের প্রধান পদগুলো দখল করতে শুরু করেছে। তিন প্রজন্ম শেষে এখন এই পরিবারের চতুর্থ প্রজন্ম শ্রীলঙ্কা শাসনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেখানে রাজাপাকসে পরিবার এমন নজির স্থাপন করেছে, বাইরে থেকে অনেকেই এটিকে শ্রীলঙ্কার রাজ পরিবার মনে করে ভুল করবে।