মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবারের কারণে রক্তে মন্দ কোলেস্টেরলের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়, যার ফলে হৃদ্রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি বাড়ে। ডায়াবেটিসসহ আরও নানা জটিল রোগের পেছনেও ভূমিকা রয়েছে ট্রান্স ফ্যাটের। খাদ্যদ্রব্যে ক্ষতিকর এই চর্বিজাতীয় পদার্থের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্বের নানা দেশ।
খাবারে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা সর্বোচ্চ ২ শতাংশের মধ্যে রাখার পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ২০২৩ সালের মধ্যে তা ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রাও নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে খাদ্যের মাননিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর এ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা নেই।সেই সুযোগে দেশের বেকারি পণ্যে ইচ্ছেমতো ট্রান্স ফ্যাট ব্যবহৃত হচ্ছে। এক গবেষণায় ঢাকার বাজার থেকে সংগৃহীত বেকারির বিস্কুটে ৫-৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের ইপিডোমিলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী জানান, এক গবেষণায় তাঁরা দেখেছেন ডালডা বা বনস্পতিতে মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট রয়েছে। বেকারি পণ্যে ডালডা বেশি ব্যবহার হয়। এতে বেকারির পণ্য খেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেকারিতে উৎপাদিত পাউরুটি, বিস্কুট ও কেকের মতো পণ্য তৈরিতে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয় ডালডা বা বনস্পতি। এই ডালডাই হচ্ছে ট্রান্স ফ্যাটের অন্যতম প্রধান উৎস। এতে ২৫-৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাট থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত কোনো প্যারামিটার বা মান নির্ধারিত না থাকায় বেকারি পণ্যে ব্যবহৃত ডালডায় কী পরিমাণ ট্রান্স ফ্যাট রয়েছে, তা জানার কোনো সুযোগই নেই।.
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিএসটিআইয়ের পরিচালক (মান) নিলুফা হক বাংলা ম্যাগাজিনকে বলেন, ডালডায় ট্রান্স ফ্যাটের প্যারামিটার নেই। সময়ের প্রয়োজনে বিভিন্ন পণ্যে প্যারামিটার সংযোজন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) খাবারে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেই নির্দেশনা সবাইকে অনুসরণ করতে হবে।
কৃত্রিম বা আংশিক জারিত উদ্ভিজ্জ তেলের সঙ্গে যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পার্শিয়াল হাইড্রোজেন যুক্ত করা হলে তা জমে গিয়ে কঠিন বা অর্ধকঠিন অবস্থা ধারণ করে। এই হাইড্রোজেনেটেড তেল ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস। এই তেলকেই ডালডা বা বনস্পতি বলা হয়। খাবারের সঙ্গে এই তেল শরীরে প্রবেশ করে। শরীর এই তেলের হাইড্রোকার্বন ভাঙতে পারে না। তাই তা রক্তে রয়ে যায়। এতে রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং হৃদ্রোগসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মন্দার বাজারে সস্তায় ভোজ্য স্নেহপদার্থের জোগান দেওয়ার জন্য হাইড্রোজেনেটেড তেল তৈরি হয়েছিল। এরপর ক্রমশ এর ব্যবহার বাড়তে থাকে। কিন্তু ১৯৮০ সালের দিকে এর ক্ষতিকার দিকগুলো সামনে আসার পর ক্ষতিকর এই ফ্যাটের ব্যবহার কমানোর ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা বেঁধে দিয়ে গত বছর প্রবিধানমালা প্রণয়ন করেছে বিএফএসএ। চলতি বছরের ডিসেম্বর নাগাদ এটি কার্যকর হওয়ার কথা। বিএফএসএ’র সদস্য (জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টি) মঞ্জুর মোর্শেদ আহমেদ বলেন, খাবারে ২ শতাংশের বেশি ট্রান্স ফ্যাট থাকতে পারবে না। এ ব্যাপারে প্রবিধানমালা তৈরি হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে রাজধানীর ওয়ার্ডভিত্তিক ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের সঙ্গেও বৈঠক হবে।
অথচ ব্যবসায়ীরা বলছেন অন্য কথা। এ ব্যাপারে এখনো তাঁরা কিছুই জানেন না। বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট ও বাংলাদেশ কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বেকারিতে দীর্ঘদিন ধরেই ডালডা ব্যবহার হচ্ছে। তাতে কী পরিমাণ ট্রান্স ফ্যাট আছে, এ বিষয়ে তাঁরা কিছুই জানেন না। সরকারের কোনো সংস্থাও বিষয়টি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি।