উইগ বা পরচুলা তেমনি একটি পণ্য, যা আমাদের অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা পূরণে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে।মেয়েদের মাথা থেকে প্রাকৃতিকভাবে ঝরে যাওয়া চুল আমরা আবর্জনা হিসেবে ফেলে দেই, যা একশ্রেণীর পেশাদার মানুষ সংগ্রহ করে রফতানীকারকদের হাতে পৌঁছে দেয়।
সর্বোপরি এই চুল বিভিন্ন পন্থায় সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে রফতানির কাজ করছে থ্রিএনআরএস। সাধারণত কাঁচামাল বা চুল সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ফাইবার ও ক্যাপ তৈরি করে রফতানি করা হয়।
বৈশ্বিক উইগ বা পরচুলা শিল্পে চীনারা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে। পরচুলা ফ্যাশনেবল বটেই, একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় ব্যাপক চাহিদাসম্পন্ন। ব্যবহার অনুপযোগী একটি জিনিসকে সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে মানুষের মাথায় ব্যবহার যোগ্য হিসেবে তৈরি করে উইগ এবং উইফট হিসেবে রফতানি করা হয়।
স্টার্টআপ থ্রিএনআরএস কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিফাত হোসেন মজুমদার বলেন, থ্রিএনআরএসের যাত্রা হয় সাত বছর আগে। শুরুটা বিভিন্ন রফতানি পণ্যের প্যাকেজিং দিয়ে হয়েছিল। বরাবরই অপরিচিত পণ্য নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী ছিলাম। উইগ বা পরচুলা তেমনি একটি পণ্য, যা আমাদের অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা পূরণে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, বিশ্বের খুব কম মানুষ প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে নতুন কিছু সৃষ্টির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে। আমি মনে করি তারাই প্রকৃত উদ্যোক্তা। তাই আমি ভিন্ন ধরনের খাত নিয়ে কাজ করতে চেয়েছি। আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশের ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা পরচুলা শিল্পে নিজেদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে সম্ভাবনাময় এ খাতকে বৃহত্ শিল্প আকারে রূপদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।
সরকারি সহায়তা ছাড়া এবং সংগঠনবিহীন এ ব্যবসায় খাতটিকে এগিয়ে নিতে ব্যক্তি উদ্যোগে বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৪০-৫০ টন চুলপণ্য শুধু ফাইবার হিসেবে রফতানি করা হচ্ছে। বাইরের দেশে পরচুলার একটি বিস্তৃত বাজার রয়েছে। মুনাফার দিক বিবেচনা করলে গার্মেন্টস শিল্পের পাশাপাশি অন্য যেকোনো শিল্পের চেয়ে চুল শিল্প বেশি লাভজনক। গত অর্থবছর (২০১৭-১৮) শুধু ফাইবার রফতানি করে প্রায় ২৯০ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।
মাঠ পর্যায়ে চুল সংগ্রহের কাজটা করেন হকাররা। তারা বিভিন্ন পণ্যের বিনিময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের কাছ থেকে ঝরে পড়া চুল সংগ্রহ করেন। মহিলারা আগে জানত না, তাই চুল আঁচড়ানোর পর যেগুলো ঝরে পড়ত, সেগুলো ফেলে দিত। এখন সবাই জানে চুলের বিনিময়ে বিভিন্ন পণ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশে পরচুলা ব্যবসার উত্পত্তি চুয়াডাঙ্গা জেলায়। সেখানকার হকাররাই বিভিন্ন জেলা থেকে চুল সংগ্রহের কাজ করতেন এবং তাদের হাত ধরেই পরচুলার প্রচলন ঘটে।
এই হকাররা গ্রাম থেকে সংগ্রহ করে সেগুলো জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে ভেন্ডরদের কাছে বিক্রি করে। সেসব ভেন্ডরের কাছ থেকে এসব সংগ্রহ করি। কাঁচামাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত ১০ ইঞ্চির বেশি লম্বা চুল চাই। ২০ ইঞ্চির বেশি লম্বা চুল কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর ফাইবার হিসেবে রফতানি ক্ষেত্রে কেজিপ্রতি ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিদেশের মার্কেটে দাম পাওয়া যায়। যদি ২৫ ইঞ্চি লম্বা হয় সেক্ষেত্রে কেজিপ্রতি ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম ওঠে।
অটো কারখানায় প্রায় ১৮-২০ ধরনের ছোট-বড় মেশিন ব্যবহার হয়। বাংলাদেশে অবস্থিত বিদেশী কোম্পানিগুলো এসব মেশিন ব্যবহার করছে। থ্রিএনআরএসের কারখানা সেমি-অটো। তাই আমরা খুব বেশি মেশিন ব্যবহার করছি না। আমরা জ্যাক নামে এক ধরনের মেশিন ব্যবহার করছি। এছাড়া থ্রিহেড ওভার লক, হিট বক্স, সোডিয়া ও স্পেশাল ডাইস নামে কয়েকটি মেশিন ব্যবহার করছি। বাকি কাজ কর্মীরা সুইয়ের মাধ্যমে করেন।
পরচুলা শিল্পে দুই ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। প্রথমত. সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের সহায়তা পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত. যেহেতু রফতানিমুখী শিল্প, কাজেই আমাদের বাইরের দেশের ক্রেতারা যদি পণ্য ক্রয়ের ধারাবাহিকতা ব্রেক করে, সেক্ষেত্রে বড় ধরনের লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে। ক্রেতারা যাতে মুখ ফিরিয়ে না নেয়, সেজন্য পণ্যের মানের বিষয়ে আপসহীন হতে হবে। দেশে পরচুলা তৈরির প্রচুর কাঁচামাল আছে এবং অন্য যেকোনো বাজারের চেয়ে সস্তা। কাজেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অন্য কোনো কারণে কাঁচামাল সংকটে পড়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক চুল থেকে তৈরি পরচুলা খুব বেশি ব্যবহার হয় না। এর পুরোটাই রফতানিনির্ভর শিল্প। দেশে যেসব পরচুলা মিলছে, এগুলো সিনথেটিক কিংবা প্লাস্টিক দিয়ে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি, যেগুলো খুবই নিম্নমানের। মিডল ক্লাসের কথা বিবেচনা করেও প্রাকৃতিক চুল দিয়ে যদি উইগ বানানো হয়, যার প্রতি পিস পণ্যের বিক্রয়মূল্য হবে ১০-১৫ হাজার টাকা। চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য কিছু কোম্পানি মাঝে মধ্যে খুচরা বিক্রি করে।