রাজধানীর মিরপুরে ডঃ বুলবুলের মৃত্যু নিয়ে রহস্য
রাজধানীর মিরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়ায় দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে গরিবের ডাক্তার খ্যাত চিকিৎসক আহমেদ মাহি বুলবুল রহস্যজনকভাবে খুন হয়েছেন। তিনি একজন দন্ত চিকিৎসক ছিলেন। রাজধানীর মগবাজারে রংপুর ডেন্টাল নামে একটি চেম্বারে চিকিৎসা দিতেন ডা. বুলবুল। সেখানে তিনি দরিদ্র ও নিম্নবিত্তদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন।
এই হত্যার পেছনে পূর্বশত্রুতা বা অন্য কোনো কারণ আছে কিনা তা তদন্ত করে দেখছে পুলিশ। গতকাল রোববার ভোর ৫টার দিকে ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে বুলবুল মারা যান বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য। ছিনতাইকারীরা তাকে ছুরিকাঘাত করলেও সঙ্গে থাকা ১২ হাজার টাকা, দামি মুঠোফোন কিছুই নেয়নি। শুধুমাত্র একটি পুরাতন ফোন খোয়া গেছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিরপুরের ১১৮/এফ পশ্চিম শেওড়াপাড়া আনন্দবাজারের ভাড়া বাসায় স্ত্রী এবং দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকতেন চিকিৎসক বুলবুল। রাজধানীর মগবাজারে তার নিজস্ব ডেন্টাল চেম্বার রয়েছে। ঘটনার দিন ভোর পাঁচটায় মিরপুরের ওই বাসা থেকে নোয়াখালীতে তার ঠিকাদারি ব্যবসার কাজের উদ্দেশ্যে বের হন। এ সময় রংমিস্ত্রি এবং তার সহযোগী সোহরাবকে ফোন দিয়ে বের হতে বলেন।
একটি রিকশা নিয়ে পশ্চিম শেওড়াপাড়ার মূল সড়কে এলে তিনজন ছিনতাইকারী ভোর ৫টা ১৯ মিনিটে তার গতিরোধ করে উরুতে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে থাকা পথচারীরা উদ্ধার করে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে কিছুক্ষণ পর তার মৃত্যু হয়।
রহস্যজনক এই মৃত্যুকে ঘিরে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে তিনজনকে অজ্ঞাত আসামি করে মিরপুর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। এ ঘটনায় পূর্বশত্রুতা, ঠিকাদারি ব্যবসা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং ছিনতাই এ বিষয়গুলোকে সামনে রেখে ঘটনাটি তদন্ত করছে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের পাশাপাশি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)সহ একাধিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
মামলার এজাহারের বরাত দিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে অজ্ঞাত তিন ব্যক্তিকে আসামি করে মিরপুর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলা নম্বর ৬০। নোয়াখালীর ঠিকাদারির কাজের উদ্দেশ্যে সকাল সোয়া ৫টার সময় বাসা থেকে একটি রিকশায় যাচ্ছিলেন। সাড়ে ৫টার সময় ঘটনাস্থলে মেট্রোরেলের ২৭৮ নম্বর পিলারের কাছে আসেন।
এ সময় তিনজন অজ্ঞাত ছিনতাইকারী তার কাছ থেকে একটি পুরনো মুঠোফোন ছিনিয়ে নেয়। এ সময় সঙ্গে থাকা অন্যান্য জিনিস নিতে চাইলে ধারণা করা হচ্ছে বাধা দেন বুলবুল। ছিনতাইকারীরা তার ডান পায়ের উরুতে একটি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়।
এ সময় তার সঙ্গে নগদ ১২ হাজার টাকা এবং আরেকটি মুঠোফোন ছিল। যেগুলো কিছুই নেয়নি ছিনতাইকারীরা। পরবর্তীতে তাকে স্থানীয় আল হেলাল হাসপাতালে পথচারীরা নিয়ে যান। সেখান থেকে কাফরুল থানা পুলিশ তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসক সকাল সোয়া ৬টার সময় তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাস্থলের আশেপাশের ভিডিও ফুটেজ ইতিমধ্যে জব্দ করেছে পুলিশ।
এদিকে গরিবের ডাক্তার খ্যাত দন্ত চিকিৎসক বুলবুলের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে হাসপাতালে তার প্রতিবেশী, বন্ধু, সহকর্মী চিকিৎসকসহ অনেকে ছুটে আসেন। বুলবুলের এক প্রতিবেশী এবং বন্ধু শামছুজ্জামান জানান, সকাল সাড়ে ৯টায় একটি অপরিচিত মুঠোফোন থেকে ফোন দিয়ে বলা হয় বুলবুলকে কেউ একজন গুলি করেছে। বুলবুলের বাসার কাছেই তার মুদি দোকান। গত কয়েক মাস আগে পশ্চিম শেওড়াপাড়ার ভাড়া বাসায় ওঠেন তারা। খুব অল্পদিনেই তাদের মধ্যে একটি ভালো বন্ধুত্ব তৈরি হয়।
নোয়াখালীতে একটি ঠিকাদারির কাজে যাওয়ার কথা ছিল। ঘটনার আগের দিন রাত ১১টায় বুলবুল তার মেয়ের স্কুল ড্রেসের একটি বেল্ট এবং মেয়েকে সকালে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তাকে। কিন্তু পরদিন এরকম ঘটনা ঘটবে যেটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তার বন্ধু প্রতিবেশী এবং সহকর্মীরা।
বুলবুলের স্ত্রী সাম্মী আক্তার শান্তা বলেন, তিনি একটি স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। দুই ছেলে মেয়ে এবং স্বামীকে নিয়ে গত কয়েক মাস আগে নতুন ভাড়া বাসায় ওঠেন। ঘটনার দিন ভোর ৪টার কিছু পরে ঘুম থেকে উঠে নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে তৈরি হন বুলবুল।
এ সময় তাকে বলেন, আমি যাচ্ছি। বাচ্চাদের দেখে রেখো। সাবধানে থেকো। এটাই ছিল তার সঙ্গে শেষ কথা।তিনি বলেন, তার জানা মতে বুলবুলের কোনো শত্রু ছিল না। তবে একটি ব্যাংক লোন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে তিনি দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন।
বুলবুলের সহযোগী রংমিস্ত্রি সোহরাব বলেন, ভোর সাড়ে ৪টায় ফোন পেয়ে তিনি মহাখালী থেকে হেঁটে জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত আসেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনে এসে একাধিকবার ফোন দিলেও কেউ রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে পুলিশের এক সদস্য ফোন দিয়ে তাকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসতে বলেন। হাসপাতালে এসে বুলবুলের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন।
চিকিৎসক বুলবুলের এই সহযোগী বলেন, সম্প্রতি বুলবুল প্রায় ১২ কোটি টাকার সরকারি একটি কাজ পেয়েছেন নোয়াখালীতে। পুরনো ভবনের কনস্ট্রাকশন ঠিকাদারির কাজের উদ্দেশ্যে তিনি বাসা থেকে বের হন। তিনি বলেন, গত চার বছর ধরে বুলবুলের সঙ্গে কাজ করছেন। এর আগেও বুলবুলের সঙ্গে তিনি তিনটি সাইটে রংয়ের কাজ করেছেন। ঠিকাদারি কাজ নিয়ে বুলবুলের সঙ্গে কারোর উল্লেখযোগ্য কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।
বুলবুলের বন্ধু ডা. তৌফিক এলাহী এবং ডা. রেজা খান বুলবুলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেখা হয় না তাদের। বুলবুলের একটি স্বপ্ন ছিল দন্ত চিকিৎসার বিষয়ে দেশব্যাপী ফ্রি ক্যাম্পের ব্যবস্থা করবেন। এছাড়া রংপুরে একটি হাসপাতাল গড়বেন। যেখানে তিনি সাধারণ মানুষকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করবেন। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে বুলবুল সম্পৃক্ত ছিলেন। সব স্বপ্ন নিমিষেই শেষ হয়ে গেল।
বুলবুলের স্ত্রী বলেন, স্বামীকে হারিয়ে এখন দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবেন, সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে? হিসাব মেলাতে পারছেন না স্ত্রী শান্তা। নিহতের ভাগিনা রবিউল বলেন, চিকিৎসক বুলবুল ‘ভূমি’ নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতেন। এর বাইরে তিনি কিছু ঠিকাদারি কাজ করতেন বলেও জানান রবিউল।
পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আ স ম মাহাতাব উদ্দিন বলেন, ডা. বুলবুল ভোর সাড়ে ৫টার দিকে শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে বের হন নোয়াখালী যাওয়ার জন্য। বুলবুল তার সহকারীকে ফোন দিয়েছিলেন। বুলবুলের উরুতে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছে চিকিৎসক। তার কাছে টাকা-পয়সা, মোবাইল ছিল। সেগুলো কিছুই খোয়া যায়নি। ছিনতাইয়ের ঘটনা হলেও বিষয়টিকে রহস্যজনক হিসেবে ধরে তদন্ত করছে পুলিশ।
মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোস্তাজিরুর রহমান বলেন, ঘাতক কিছুই নেয়নি। নিহত চিকিৎসকের কাছে থাকা ১২ হাজার টাকা ও মোবাইলফোন নেয়নি ঘাতক। ছুরিকাঘাতের পর ওই চিকিৎসককে উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তিনি মারা যান বলে জানান কর্তব্যরত চিকিৎসক। ঘটনাটি আমরা খতিয়ে দেখছি। নিহতের ভাগিনা রবিউল জানায়, ডা. বুলবুলের গ্রামের বাড়ি রংপুরের ভগিবালাপাড়া গ্রামে। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নেয়া হবে। বুলবুলের বাবার নাম মৃত আব্দুস সামাদ।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আ ম সেলিম রেজা বলেন, প্রাথমিকভাবে নিহতের পায়ের উরুতে একটি আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে এবং অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে বিস্তারিত জানা যাবে।