রাজধানীর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপুর একাধিক খুনি এখন গোয়েন্দা জালে। ঘটনার পরপরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ গোয়েন্দাদের ব্যাপক তৎপরতায় সরাসরি হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহভাজন খুনিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে আনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় খুনি প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এদিকে, কী কারণে টিপুকে খুন করা হয়েছে, নেপথ্য কারণই বা কী- এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো ধারণা দিয়ে বলছে, ক্রীড়া পরিষদের ৩৭টি টেন্ডার, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব, মতিঝিলসহ আশপাশের এলাকায় চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা, রাজনৈতিক আধিপত্য ও এক দশক আগে খুন হওয়া মিল্কি হত্যার বিষয় এর পেছনে কাজ করতে পারে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা বাংলা ম্যাগাজিনকে বলেন, আরেকটু যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। র্যাবের গোয়েন্দা শাখা থেকেও প্রায় একই তথ্য পাওয়া গেছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি ও র্যাবের ফরেনসিক টিম ঘটনাস্থল থেকে ফরেনসিক আলামত সংগ্রহ করেছে।
জানা গেছে, মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও ফ্রিডম মানিকের সঙ্গে নিহত টিপু দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন। পরিবার প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা বলে এবং সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে টিপুকে খুন করার একটি নীলনকশার চিত্র পাওয়া যায়। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, টিপু খুন হতে পারেন- এমন একটি ধারণা গত সপ্তাহেই দেওয়া হয়েছিল। অপরিচিত একটি নম্বর থেকে ফোন করে টিপুকে বলা হয়েছিল- ‘চাচা আপনি খুন হতে পারেন’।
ফুটেজে দেখা যায়, পলো শার্ট, বুকের সামনে ব্যাগ আর মাথায় হেলমেট পড়া খুনি মোটরসাইকেল থেকে নেমে আসে। এরপর মাইক্রোবাসের সামনে সিটে বসা টিপুর গাড়িতে গুলি চালায়। গুলিতে গাড়ির কাচ ভেঙে যায়। এ সময় ২০ সেকেন্ডের মধ্যে টিপুকে লক্ষ্য করে ১২টি গুলি করা হয়। ঘটনার রাতে ওই রাস্তার উল্টো দিকের মার্কেট বন্ধ ছিল। রাস্তাও ছিল ফাঁকা। ফলে গুলির পরপর দ্রুত সটকে পড়া সহজ হওয়ায় খুনিরা বৃহস্পতিবার রাতের নিস্তব্ধ সময় বেছে নেয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, দীর্ঘদিনের পরিকল্পনায় টিপুকে খুন করা হয়। প্রতিদিন একই রাস্তা দিয়ে বাসায় ফিরতেন টিপু। এটি খুনিরা জানতেন। হত্যাকাণ্ডের আগে খুনিরা এলাকা রেকিও করেছে।পরিকল্পনা মতো, বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটের দিকে খুনিরা মতিঝিল কলোনিবাজার থেকে একটি মোটরসাইকেল করে টিপুর মাইক্রোবাসের পিছু নেয়। অপরাধীরা রেকি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানতো, টিপুর বাড়ির কাছাকাছি রেলগেট এলাকায় গাড়িটি যানজটে আটকে যাবে। সেটি মাথায় রেখেই কিলিং মিশনে অংশ নেয় তারা। টিপুর গাড়ি যানজটে আটকে গেলে রোড ডিভাইডারের ফাঁকা দিয়ে তারা মোটরসাইকেল উল্টো পথে নিয়ে টিপুর গাড়ির কাছাকাছি রাখে।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, খুনি চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে খুনিকে ধরার আগ পর্যন্ত খুনের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব ছিল। প্রায় এক দশক আগে আরেক আওয়ামী লীগ নেতা মিল্কি খুনের পর টিপুর রাজনীতিতে পতন হয়।
তবে স্থানীয় রাজনীতির প্রভাবে পাশাপাশি বিভিন্ন টেন্ডার তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এর মধ্যে শুধু গত বছরই ক্রীড়া পরিষদের ৩৭টি টেন্ডারের তিনি নিয়ন্ত্রণ করেন। এটা নিয়ে তার সঙ্গে অন্যদের বিরোধ তৈরি হয়। আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল। ফুটপাতে দোকান বসানো ও বাজারের দোকান নিয়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধ চলে আসছে। আধিপত্য ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে স্থানীয়দের পাশাপাশি দেশের বাইরে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়। শুধু স্বার্থের বিরোধ নাকি তার সঙ্গে মিল্কি খুনের প্রতিশোধ যুক্ত হয়েছে খুনি গ্রেপ্তারের পরই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
২০১৩ সালের ২৯ জুলাই রাতে গুলশান-১ নম্বরে সপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কি (৪৩) কে সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনায় মিল্কির ছোট ভাই মেজর রাশেদুল হক খান মিল্কির বাদী হয়ে দায়ের করা মামলায় জাহিদুল ইসলাম টিপু আসামি ছিলেন। র্যাবের হাতে টিপু গ্রেপ্তার হয়ে কয়েকমাস জেলেও ছিলেন। পরবর্তীতে র্যাবের দেওয়া চার্জশিট থেকে টিপুর নাম বাদ পড়ে। মিল্কি হত্যার পর টিপুর সঙ্গে যুবলীগের খালেদ ও সোহেল শাহরিয়ারসহ অনেকের সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় বলে দলের একাধিক নেতা জানান।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে শুক্রবার র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বেশকিছু মোটিভ পাওয়া গেছে, সে অনুযায়ী কাজ চলছে। সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। যে ব্যক্তি মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে গুলি করেছে সিসিটিভির ফুটেজ দেখে তাকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা অনেকদূর এগিয়ে গেছি। র্যাব ছাড়াও অন্যান্য বাহিনী কাজ করছে।