ভারতীয় জাল রুপি পাচারে জড়িত অভিযোগে আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে পণ্যের মোড়কে জাল রুপির চালান আসছে। এরপর সেসব জাল মুদ্রা ঢাকায় এনে পাঠানো হচ্ছে সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সেখান থেকে পাচার করা হচ্ছে ভারতে। এই চক্রে দেশে–বিদেশে অন্তত ৩০ জন সদস্য সক্রিয় রয়েছেন।
ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান জানান, গত বছর নভেম্বরে ৭ কোটি ৩৫ লাখ জাল রুপি উদ্ধারের ঘটনায় রাজধানীর খিলক্ষেত থানায় মামলা হয়। এর সূত্র ধরে গত ৭ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড এলাকা থেকে নোমানুর রহমান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই নোমানুর করাচিতে অবস্থানরত ফজলুর রহমানের ভাই।
জিজ্ঞাসাবাদে নোমানুর স্বীকার করেন, তাঁর ভাই বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান থেকে সমুদ্রপথে মোজাইক পাথর, শুঁটকি ও অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর বস্তার মধ্যে ভারতীয় জাল মুদ্রা বাংলাদেশে পাঠান। এরপর জাল রুপির একটি চালানের একাংশসহ তাঁদের আরেক ভাই সাইদুর রহমান, ব্যবসায়ী আবু তালেব ও ফাতেমা আক্তার নামের এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকা থেকে হুন্ডি ব্যবসায়ী শাজাহানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
জাল রুপি পাচারের পুরো কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে পাকিস্তানের বন্দরনগরী করাচি থেকে। ফজলুর রহমান নামে মুন্সিগঞ্জের এক ব্যক্তি সেখান থেকে জাল রুপির চালান পাঠান। এই চালান আসে শেখ মো. আবু তালেব নামে ঢাকার এক ব্যবসায়ীর আমদানি পণ্যের নামে। এরপর ফজলুর রহমানের দুই ভাই ও এক ভগ্নিপতি এবং চক্রের অপর সদস্যরা সেগুলো ঢাকা হয়ে ভারতে পাচার করেন। এই চক্রে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন গাড়িচালকও রয়েছেন।
গাড়িচালক আমানউল্লাহ ভূঁইয়া, ব্যবসায়ী আবু তালেবসহ গ্রেপ্তার পাঁচজন ইতিমধ্যে ঢাকার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ ঘটনায় হওয়া দুটি মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার বলেন, পাকিস্তানের করাচিতে বসে স্থানীয় চক্রের প্রধান ফজলুর রহমান ওরফে ফরিদ বাংলাদেশে ভারতীয় জাল মুদ্রার কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন। চক্রের সদস্যরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে জাল রুপির বড় একটি অংশ পাচার করেন। আর বাকি অংশ চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর সীমান্ত এবং শিবগঞ্জের সোনামসজিদ স্থলবন্দরে ফেনসিডিল, অস্ত্র, চোরাই মুঠোফোন, গাঁজাসহ বিভিন্ন অবৈধ সামগ্রী বেচাকেনায় ব্যবহার করেন।
গত বছরের চালানের বাকি জাল রুপি আমানউল্লাহ ভূঁইয়া–কাজল রেখা দম্পতির হাজারীবাগের মনেশ্বর রোডে বাড়ির নিচতলায় রাখা হয়। সেখানে অভিযান চালিয়ে আমানউল্লাহ ও তাঁর শ্যালক ইয়াসির আরাফাত ওরফে কেরামতকে আটক করা হয়। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে ১২ লাখ ভারতীয় জাল মুদ্রা উদ্ধার করা হয়। আমানউল্লাহ ভূঁইয়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সুনামগঞ্জ জেলা শাখার গাড়িচালক। পরে আবার ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে ৩ লাখ জাল রুপিসহ কাজল রেখাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় হাজারীবাগ থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করা হয়।
পাকিস্তানের করাচিতে অবস্থানরত চক্রের হোতা ফজলুর রহমানের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে। তাঁর পরিবারের অধিকাংশ সদস্য একসময় পাকিস্তানে থাকতেন। সেখান থেকেই ফজলুর বাংলাদেশে ভারতীয় জাল রুপির কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন। সেখানে তাঁর নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি দল এই কাজে জড়িত। দেশে এই কারবারে ফজলুরকে সহযোগিতা করেন ভাই সাইদুর রহমান, নোমানুর রহমান ও ভগ্নিপতি শফিকুর রহমান।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা মশিউরের দেওয়া তথ্যমতে, কাজল রেখার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের বেনীচক গ্রামে। স্বামী আমানউল্লাহ ছাড়াও তাঁর ভাই ইয়াসিন আরাফাত, বোন শারমিন দোয়েল, ভগ্নিপতি সোনামিয়া, চাচা আয়নাল হোসেন, ভাগনে ফিরোজ, কিবরিয়া ও ভাতিজা নেলসন জাল রুপি চোরাচালানে জড়িত। তাঁরা প্রথম দিকে বিমানযাত্রী সেজে লাগেজে করে এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে জাল রুপি ঢাকায় আনতেন। পরে সেগুলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পাচার করতেন।
মামলার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, গত ছয় বছরে ডিবি ভারতীয় জাল মুদ্রাসহ ২০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এঁদের অন্তত ছয়জন পাকিস্তানি। জাল রুপি পাচার চক্রের সদস্যরা অবৈধ উপায়ে ব্যাংক ও হুন্ডির মাধ্যমে পুরো লেনদেন করতেন। গত এক বছরে চক্রটি দেশের তিনটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৩ কোটি ৩৯ লাখ ৭৮ হাজার ৬৭৯ টাকা লেনদেন করেছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, এক যুগ ধরে পাকিস্তান থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে ভারতীয় জাল রুপির কারবার। এ কাজে জড়িত চক্র জাল রুপি খালাস করে গুদামে মজুত, ডিলারদের মধ্যে সরবরাহ করা এবং বিক্রি করা জাল মুদ্রার অর্থ বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে সংগ্রহ করতেন। পরে তা হুন্ডি করে পাকিস্তানে ফজলুর রহমানের কাছে পাচার করতেন। চক্রের সদস্যরা ১ লাখ ভারতীয় জাল মুদ্রা ৩৮ হাজার টাকায় কিনে ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকায় বিক্রি করে আসছিলেন। প্রতি লাখ ভারতীয় জাল মুদ্রা বিক্রি করে চক্রের সদস্যরা পেতেন তিন থেকে চার হাজার টাকা করে।
গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংকের গেন্ডারিয়া শাখার একটি অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৯৩ লাখ ৭২ হাজার ৩৫১ টাকা লেনদেন করেছে চক্রটি। অপর দিকে ইসলামী ব্যাংকের মতিঝিল শাখার একটি অ্যাকাউন্টে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৯৬২ টাকা লেনদেন হয়েছে। এ ছাড়া ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন হয়েছে ২১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৩৬ টাকা।
ফজলুর রহমান পাকিস্তানের অপরাধীদের সঙ্গে মিলে ভারতীয় জাল রুপির কারবার করেন। করাচিতে বসবাসরত বাংলাদেশের নাগরিক শফি ও তাঁর ছেলে সুলতান ভারতীয় জাল রুপি তৈরি করেন। আবার অন্যের কাছ থেকেও জাল রুপি সংগ্রহ করেন তাঁরা। পরে সেগুলো পাকিস্তান থেকে ফজলুর রহমানের মাধ্যমে করাচি বন্দর থেকে শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হয়।