অবৈধভাবে পাঁচ কোটি টাকার মালিক হন নরসিংদীর মফিজুর রহমান। এই টাকার উৎস যাতে কেউ জানতে না পারে, সে জন্য তা ব্যাংকে রাখেননি তিনি। নিজের বাসার খাটের নিচে এই টাকা তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন। বাসায় এত টাকা রাখার তথ্য স্ত্রী শামীমা নূর ওরফে পাপিয়াকেও জানাননি তিনি। তবে মফিজুর যখন ভারতে অবস্থান করেন, তখন পাপিয়া বাসার খাটের নিচে টাকা থাকার তথ্য জেনে যান। এই অবৈধ টাকা পরে খরচ করেন পাপিয়া।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম অ্যান্ড অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের পরিদর্শক ইব্রাহীম হোসেন সম্প্রতি আদালতে এ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন।তিনি বলেন, মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। তদন্ত অনুযায়ী, মফিজুরের অপরাধলব্ধ আয়ের পরিমাণ পাঁচ কোটি টাকা। এই টাকার উৎস লুকাতে তিনি তা বাসার খাটের নিচে লুকিয়ে রাখেন। এই অবৈধ টাকা ওয়েস্টিন হোটেলে খরচ করেন তাঁর স্ত্রী পাপিয়া।
মফিজুর ও পাপিয়ার বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান থানায় হওয়া অর্থ পাচার মামলা তদন্ত করে ঢাকার আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগের (সিআইডির) তদন্ত প্রতিবেদনের পাশাপাশি মামলার কেস ডকেট থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
মফিজুর-পাপিয়ার আইনজীবী শাখাওয়াত উল্লাহ ভূঁইয়া বলেন, অর্থ পাচার মামলায় তাঁর মক্কেলদের অভিযুক্ত করে সিআইডি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বলে জেনেছেন। তবে এ প্রতিবেদনের অনুলিপি তিনি এখনো হাতে পাননি।আইনজীবী শাখাওয়াতের দাবি, তাঁর মক্কেলেরা নির্দোষ। তাঁরা কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন।
সিআইডির কাছে মফিজুরের দেওয়া ১৬১ ধারার জবানবন্দির তথ্য বলছে, তিনি ১৯৯৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। কলেজে পড়া অবস্থায় নরসিংদীর তৎকালীন পৌর মেয়র লোকমান হোসেনের মাধ্যমে ছাত্রলীগে যোগ দেন।
নরসিংদী সরকারি কলেজে পড়ার সময় পাপিয়ার সঙ্গে মফিজুরের সম্পর্ক হয়। পরে তাঁরা বিয়ে করেন। একপর্যায়ে পাপিয়া নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। অবশ্য গ্রেপ্তারের পর পাপিয়াকে যুব মহিলা লীগ থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
আদালতে সিআইডির দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৭ বছরের ব্যবধানে অবৈধভাবে পাঁচ কোটি টাকার মালিক হন মফিজুর। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, হুমকি, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এ টাকা অর্জন করেন তিনি।
দুই বছর আগে ২০২০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার হন মফিজুর ও পাপিয়া।অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে একই বছরের ১২ অক্টোবর মফিজুর ও পাপিয়াকে ২০ বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত।এ ছাড়া জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের করা একটি মামলায় এখন মফিজুর ও পাপিয়ার বিচার চলছে।
১৯৯৬ সালে স্থানীয় কমিশনার মানিক খুন হয়। এ খুনের ঘটনায় মফিজুরকে আসামি করা হয়। এর পর থেকে তিনি সব সময় নিজের কাছে অবৈধ পিস্তল রাখতেন বলে জবানবন্দিতে বলেন মফিজুর।মেয়র লোকমান খুন হলে নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে মফিজুর আশঙ্কা বোধ করেন।মফিজুর সিআইডিকে বলেছেন, ২০১৯ সালে তাঁর মনে হয়, তিনি খুন হয়ে যেতে পারেন। তখন তিনি ভারতে চলে যান। তখন বাসায় মফিজুরের রেখে দেওয়া টাকার কথা জানতে পারেন পাপিয়া।
মফিজুর সিআইডির কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, অবৈধভাবে অর্থ আয় করায় দুদক মামলা করতে পারে বলে আশঙ্কা করতেন তিনি। তাই তিনি ব্যাংকে টাকা রাখতেন না। নগদ টাকা নিজের কাছে রাখতেন। কিন্তু বিয়ের পর তাঁর টাকা দেদার খরচ করতেন স্ত্রী পাপিয়া। এর পর থেকে মফিজুর তাঁর টাকার তথ্য গোপন রাখতেন।
মফিজুর জবানবন্দিতে বলেছেন, পাপিয়া যখন বাসায় থাকতেন না, তখন ব্যাগে করে টাকা বাসায় নিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখতেন মফিজুর। এভাবে তিনি বাসার খাটের নিচে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা জমা রাখেন। এ টাকার পুরোটাই ছিল অবৈধ।
অর্থ পাচার মামলায় ১৬১ ধারার জবানবন্দি দিয়েছেন পাপিয়া। তাঁর জবানবন্দির তথ্য বলছে, ২০১১ সালে তিনি এসএসসি পাস করেন। পরে তিনি জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। এ পদ পাওয়ার পর ২০১৫ সালে কেএমসি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খোলেন।একপর্যায়ে পাপিয়া পদ-বাণিজ্য, তদবির-বাণিজ্য, চাঁদাবাজির মতো অপরাধে জড়িত হন। তাঁকে এ কাজে সহযোগিতা করেন স্বামী মফিজুর।
পাপিয়ার জবানবন্দি অনুযায়ী, ২০১৯ সালের অক্টোবরে তাঁর স্বামী মফিজুর ভারতে যান। এরপর বাসা পরিষ্কার করতে গিয়ে বক্স খাটের ভেতরে অনেক টাকা দেখতে পান। ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট গণনা করে তিনি মোট ৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা দেখতে পান।
পরে পাপিয়া ঢাকার অভিজাত হোটেল ওয়েস্টিনে গিয়ে কক্ষ ভাড়া করেন। সেখানে তিনি কয়েক মাস অবস্থান করেন। ভাড়াসহ তাঁর বিল আসে ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা। তিনি এই টাকা নগদ অর্থে পরিশোধ করেছেন।
মামলার নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, পাপিয়া হোটেল ওয়েস্টিনে ২৬টি কক্ষ ভাড়া করেছিলেন। অপরাধলব্ধ আয়ের প্রমাণ হিসেবে হোটেলের বিল পরিশোধের কাগজপত্র জব্দ করে আদালতের কাছে জমা দিয়েছে সিআইডি।