বেশ কয়েক বছর ধরে মুখ দেখাদেখি প্রায় বন্ধ যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার। তবে গত সপ্তাহে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্কে উন্নতির আভাস দিচ্ছে। দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রথমবারের মতো গত সপ্তাহে উচ্চপর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুই দেশের জন্যই এটাকে সম্পর্কের নতুন মোড় হিসেবে দেখছে বিবিসি।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলা বুঝেছে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর সংকটপূর্ণ এই সময়ে সম্পর্কের উন্নয়নটাও প্রয়োজন। ভেনেজুয়েলা তেলসম্পদে সমৃদ্ধ। রাশিয়ার তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ব যখন সংকটে, তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে তখন দুই দেশের নেতারা পুরোনো বন্ধুত্ব ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিকতার, উত্ত্যক্ত করার ও অকারণে ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ তুলেছেন মাদুরো। এতসব তিক্ততার মাঝে দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়নের বিষয়টি সহজ নয়। তবে পারস্পরিক লাভের প্রশ্ন যখন আসে তখন দুই দেশের সরকারের মধ্যেই সম্পর্ক উন্নত করার আগ্রহ দেখা গেছে।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোর বিরুদ্ধে দুর্বল গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির তেল খাতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মাদুরোর বিরুদ্ধে মাদক সন্ত্রাস, মাদক পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মার্গারিটা লা পেজ মায়া বলেন, ভেনেজুয়েলায় সবকিছুই তেলসম্পদ ঘিরে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল ভেনেজুয়েলায় ভালো রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করা। সে সময় তেলের বিষয়টি নিশ্চিত করতে ভেনেজুয়েলা সরকারকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে গুরুত্ব দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
রাজধানী কারাকাসে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রেসিডেন্ট মাদুরো বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার দুটি পতাকাই একসঙ্গে দেখতে সুন্দর। দুটি পতাকা একসঙ্গে রাখা আছে। দুই দেশের একসঙ্গেই থাকা উচিত।’মাদুরো আরও বলেন, ‘আমাদের সামনে নতুন সুযোগ এসেছে। আমাদের মধ্যে মর্যাদাপূর্ণ, আন্তরিক ও গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এটা কূনৈতিকতা, সত্য ও শান্তির মুহূর্ত।’
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি হলে তেল খাতের দিকে দিয়ে লাভবান হবে ভেনেজুয়েলা। দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো চান নিষেধাজ্ঞা উঠে যাক। গত সপ্তাহে সরকারি টিভিতে মাদুরো দুই দেশের পুর্নমিত্রতার কথা বলেন। প্রায় একই সময়ে কারাকাসের বৈঠকেও মাদুরোর কণ্ঠে বন্ধুত্বের সুর শোনা গেছে।
কারাকাসভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডাটানালিসিসের পরিচালক লুইস ভিসেনতে লিওন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাহিনী বুঝতে পেরেছে তেলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কৌশল খুব বেশি কার্যকর হয়নি। ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে তেলে নিষেধাজ্ঞা আরোপের নীতি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে কারাকাসের সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া একটু আলাদা। সেখানকার এক দোকান মালিক মারিয়া ইগুনিয়য়া ফারিনা বলেন, ‘দুই পক্ষই ভণ্ড। আমরা কাউকে বিশ্বাস করি না।’ কারাকাসের বাসিন্দা আনা পি রেজ বলেন, ‘আমরা দুর্বল। নিষেধাজ্ঞা তুলে দিলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।’
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো আরও বলেন, তিনি মেক্সিকোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। কারাকাসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠকের কয়েক দিন পরেই ভেনেজুয়েলা কারাগার থেকে মার্কিন দুই নাগরিককে মুক্তি দিয়েছে।
হিউস্টনে রাইস ইউনিভার্সিটির বেকার ইনস্টিটিউটের লাতিন আমেরিকান এনার্জি প্রোগ্রামের পরিচালক ফ্রান্সিসকো মোনালদি বলেছেন, ভেনেজুয়েলা চীনের মাধ্যমে এখন তেল রপ্তানি করে। এভাবে তেল রপ্তানিতে গত দুই বছরের তুলনায় মাদুরোকে অনেক বেশি অর্থব্যয় করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর রাশিয়া এখন চীনের মাধ্যমে হাজার হাজার টন তেল বড় ছাড়ে রপ্তানি করবে। ফলে মাদুরোর ব্যবসায় টান পড়বে।
একসময়ে ভেনেজুয়েলার দিনে ৩০ লাখ ব্যারেল তেল উৎপাদনের ক্ষমতা ছিল। আর এখন এটি কমে ১০ লাখেরও নিচে এসে পৌঁছেছে। তেলের উৎপাদন বাড়াতে ভেনেজুয়েলায় প্রচুর বিনিয়োগ প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলেই সেটা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্পমেয়াদে এটাই একমাত্র সমাধান।