অর্থ ও বাণিজ্যএক্সক্লুসিভবাংলাদেশ

কৃত্তিম সংকটের ফাঁদে সয়াবিন তেল

চারদিকেই সয়াবিন তেলের হাহাকার। বাড়তি আমদানি খরচ ও সংকট দেখিয়ে দফায় দফায় দাম বাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ গত ৭ ফেব্রুয়ারি লিটারপ্রতি খোলা সয়াবিনে সাত টাকা এবং বোতলজাতে আট টাকা দাম বাড়ায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

২০ দিন পার হতে না হতেই আবারও লিটারপ্রতি ১২ টাকা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। যদিও এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এরই মধ্যে অস্থির হয়ে উঠেছে সয়াবিন তেলের বাজার। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দামে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। ভোক্তার পকেট কাটতে সুযোগ নিচ্ছেন খুচরা বিক্রেতারাও।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন দামে। গত সপ্তাহের শুরুতে প্রতি লিটার বোতলের তেল ১৬০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা ১৮০ টাকায় পৌঁছেছে। পাঁচ লিটারের বোতলের দাম গিয়ে ঠেকেছে ৮৫০ টাকায়।

যদিও কিছু দোকানে আগের দামেই তেল পাওয়া যাচ্ছে। এর কারণ জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, দোকানে বোতল তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। কোম্পানিগুলো সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। অনেকে বন্ধও রেখেছে।

কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের ঢাকা জেনারেল স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মুজাহিদ বলেন, ‘দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের পর থেকে কোম্পানিগুলো সরবরাহ করছে না। করলেও তা অনেক কম। আমাদের চাহিদার অর্ধেক তেলও সরবরাহ করছে না তারা। জিজ্ঞেস করলে বলছে- প্রোডাকশন বন্ধ আছে।’

একই কথা জানালেন মালিবাগ বাজারের মেসার্স গাজী স্টোরের ব্যবসায়ী মো. মাসুদ রানাও, ‘কোম্পানিগুলোর কাছে তেল চেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। দোকানে মাত্র কয়েক বোতল তেল রয়েছে। অন্যান্য দোকানেও একই অবস্থা। তাই অনেকে বেশি দামে বিক্রি করছেন।’

রাজধানীতে গত এক সপ্তাহ ধরেই খোলা তেলের বাজার লাগামছাড়া। সপ্তাহের ব্যবধানে ১০ টাকা বেড়েছে খোলা সয়াবিন (সুপার) ও পামওয়েল। ১৬৫ থেকে ১৭৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে খোলা তেল, যা সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি। গত সপ্তাহে খুচরায় খোলা তেল ১৫৪ থেকে ১৬২ টাকার মধ্যে পাওয়া গেলেও এখন পাইকারিতেই ১৬১ থেকে ১৬২ টাকা কেজি দরে কিনতে হচ্ছে বলে জানান।

কারওয়ানবাজারের মেসার্স যমুনা স্টোরের বিক্রেতা মো. ওয়াসিম। খুচরা এ বিক্রেতা বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়েই খোলা তেল এখন কম রাখছেন দোকানে। অনেকে তো বিক্রিই বন্ধ রেখেছেন, যা পাওয়া যাচ্ছে তার দাম অনেক।’ মার্কেটের ঠিক পেছনেই খুচরা বিক্রেতা জসিম উদ্দিন জানান, খোলা তেলের দাম এখন বোতলের তেলকেও ছাড়িয়ে গেছে। বেশি লাভের আশায় অনেক ব্যবসায়ী বোতল কেটে ‘খোলা’ বলে বিক্রি করছেন। একটু ভালো মানের খোলা সাদা সয়াবিন এখন ১৮০ থেকে ১৮২ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে ক্ষুব্ধ ভোক্তারা বলছেন, দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের খবরে ব্যবসায়ীরা কারসাজি করছেন। বাড়তি লাভের আশায় তেল লুকিয়ে ফেলছেন তারা। ইচ্ছেমতো বোতলের দাম হাঁকাচ্ছেন। খোলা তেলের দাম বোতলের চেয়েও বেশি। নজরদারিতে ঘাটতি এবং ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে বারবার এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে এবং ভোক্তারা এর মাসুল দিচ্ছেন বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘নিবিড় নজরদারি ও ব্যবস্থাপনার ফাঁক গলে চতুর ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম হঠাৎ বাড়িয়ে দিয়ে অল্প সময়ে অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন। চাল, ডাল, তেল ও পেঁয়াজের মতো অতিপ্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যগুলোর দিকে সরকারকে আরও নজর দিতে হবে। কেবল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নয়, পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে অর্থ মন্ত্রণালয়কেও আরও উদ্যোগী হতে হবে।’

ট্যারিফ কমিশনের তথ্যানুসারে, দেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা আছে, যার ৯০ শতাংশই পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে। এ হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন ৫ হাজার ৪৭৯ দশমিক ৫০ টন (৫৪ লাখ ৭৯ হাজার ৪৫২ কেজি অথবা ৪৯ লাখ ৩১ হাজার ৫০৭ লিটার) তেলের চাহিদা রয়েছে। প্রতি লিটারে ১৭ টাকা বাড়তি দাম হিসাবে দৈনিক ৮ কোটি ৩৮ লাখ ৩৫ হাজার ৬১৫ টাকা বাড়তি মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। প্রকৃত চাহিদার হিসাবে এ মুনাফার পরিমাণ আরও বেশি।

দেশে ভোজ্যতেল বিপণনে সবচেয়ে শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি সিটি গ্রুপের পরিচালক (অর্থ) বিশ্বজিৎ সাহা  বলেন, ‘তেলের দাম নিয়ে পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো কোনো কারসাজি করছে না। ১৬৮ লিটার দরে যে তেল আমরা সরবরাহ করছি, তা আন্তর্জাতিক বাজারে টনপ্রতি এক হাজার ৩০০ ডলারে কেনা। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সেটি ১ হাজার ৪২০ ডলার ছিল। গত সপ্তাহে এ দাম বেড়ে দেড় হাজার ডলার এবং গত সোমবার তা বেড়ে ১ হাজার ৮৪০ ডলার হয়েছে। দাম আরও বাড়ছে। বাধ্য হয়েই আমরা দাম বাড়ানোর আবেদন করেছি। এখন সরকার যদি ভোজ্যতেল আমদানিতে করহার সমন্বয় করে, তা হলে দাম কিছুটা কমানো সম্ভব।’

দেশের বাজারে গত ৭ ফেব্রুয়ারি খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৪৩ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৬৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আবারও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার দোহাই দিয়ে সয়াবিনের দাম আরও বাড়াতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে চিঠি দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

চিঠিতে বলা হয়, ১ মার্চ থেকে নতুন দামে তেল বিক্রি করতে চান তারা। এ প্রস্তাবের পরেই অস্থির হতে শুরু করে বাজার। দেখা দেয় তেলের ‘সংকট’। এ বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি অবশ্য বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেছি। রমজানের আগে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হবে না।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে থাকায় আমদানি পর্যায়ে একটি নির্দিষ্ট শুল্কায়ন মূল্য ধরে তার ওপর ভ্যাট আরোপ করা যেতে পারে। আবার উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারে। ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘নিত্যপণ্যের ওপর কর থাকা উচিত নয়। ভোজ্যতেলের মতো একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে তিন স্তরে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট অযৌক্তিক।

ভোজ্যতেলের ওপর ভ্যাট উঠিয়ে দিতে পারলে ভালো। অথবা এক স্তরে কর আরোপ করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে করকাঠামো পুনর্বিবেচনা করা দরকার। শুধু তা-ই নয়, কর কমালে যাতে দাম কমে, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। করছাড় দিলে সেটি যাতে সাধারণ মানুষ পায় সেটিও নিশ্চিত করতে হবে।’

Back to top button