ইউক্রেনে হামলার কারণে রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ। এরই অংশ হিসেবে রাশিয়ার ব্যাংকগুলো থেকে সুইফট পেমেন্ট বন্ধের ব্যাপারেও আলোচনা চলছে। সুইফট বন্ধের আতঙ্কে ইতিমধ্যেই রাশিয়ার সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের পোশাক খাত।
সুইফট বন্ধের আশঙ্কায় রাশিয়ায় রপ্তানি বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে পোশাক খাত। একইসঙ্গে যুদ্ধের নানামুখী প্রভাবের কারণে রাশিয়া ও আশেপাশের দেশগুলোতে পোশাকের বাজার হারানোর শঙ্কা করছেন দেশের পোশাক শিল্পের মালিকরা। এমনকি এতে ইউরোপের বাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন বিষেশজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের পোশাক রপ্তানিতে রাশিয়ার বাজার ক্রমেই বড় হচ্ছে। সে দেশে বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। চলতি অর্থ বছর জানুয়ারি মাসের মধ্যেই রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৪১৫.৪৭ মিলিয়ন ডলারের পোশাক। যা গত বছরের তুলনায় ৩৬.৪৭ শতাংশ বেশি।
রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের শুরুতেই শঙ্কার মধ্যে ছিলেন দেশের পোশাক ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে সুইফট বন্ধের খবরে পোশাক মালিকদের সংগঠন-বিজিএমইএ তাদের সদস্যদের রাশিয়ায় পণ্য না পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছেন। বলছেন, সুইফট বন্ধ হওয়া নিয়ে রাশিয়ার বাজার নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা।
ফলে রাশিয়ার সঙ্গে অর্থ লেনদেনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে চালান পাঠানো ও পেমেন্ট পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তাই ব্যবসায়ীদের রাশিয়ার ক্রেতাদের কোনো অর্ডার গ্রহণ না করার নির্দেশনা দিয়েছে বিজিএমইএ।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, আমাদের সদস্যদের রাশিয়ায় পণ্য না পাঠানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কারণ, যুদ্ধ এবং সম্ভাব্য সুইফট বন্ধের কারণে চালান পাঠানো ও পেমেন্ট পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। তবে, রাশিয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও ইউরোপের বাজার স্থিতিশীল আছে বলে জানান বিজিএমইএ সভাপতি।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউজ এসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) সভাপতি কাজী ইফতেখার হোসেন বলেন, রাশিয়ায় আমাদের বাজার খুব বড় না হলেও কিন্তু কমও না। কারণ সেখানে নিটওয়্যারের প্রচুর এক্সপোর্ট আছে। সেই সঙ্গে নতুন করে এক্সপোর্ট শুরু হয়েছে।
আমার নিজেরও সেখানে এক্সপোর্ট আছে। রাশিয়ায় যাওয়ার জন্য ইউরোপের ট্রানজিট নিতে হয়। সেই ট্রানজিট যদি না হয় তাহলে কিন্তু পোশাক খাত হুমকির মুখে পড়ে যাবে। তিনি বলেন, রাশিয়াতে আমাদের তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে এক্সপোর্ট করতে হয়। এখন যদি সুইফট বন্ধ হয়ে যায় তাহলে পেমেন্ট করা যাবে না। আর পেমেন্ট বন্ধ থাকলে আমরা রপ্তানি করবো কীভাবে?
এটা আমাদের জন্য হুমকি স্বরূপ। কারণ পশ্চিমা বিশ্ব ছাড়া আমরা তো কোনো লেনদেন করতে পারি না। তারা সারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর্থিক লেনদেন করতে হলে আমেরিকা হয়ে আসতে হয়। যেহেতু ডলারের লেনদেন। এখন তারা নিষেধাজ্ঞা দিলে পেমেন্ট করবো কীভাবে?
বিজিএমইএ-এর সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, আমাদের সদস্যদের রপ্তানি না করার জন্য বলে দিয়েছি। কারণ সুইফট বন্ধে হলে কোনোভাবেই পেমেন্ট করা যাবে না। সুইফটের মাধ্যমেই আমাদের পেমেন্টগুলো কনফার্ম করা হয়। তাই আমরা এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ অবস্থায় রপ্তানি করলে সবাই বিপদে পড়বে। তাই আমরা সবাইকে নির্দেশনা দিয়েছি যাতে আপাতত রপ্তানি না করা হয়।
আমরা দেখছি পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। ক্রেতারাও বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। তিনি আরও বলেন, রাশিয়াতে সরাসরি সাড়ে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের পোশাক যায় বাংলাদেশ থেকে। আর ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মাধ্যমে যায় আরও সাড়ে ৩০০ মিলিয়ন ডলারের। সব মিলিয়ে আমাদের অন্তত ১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক যায় রাশিয়াতে। ইউক্রেনেও আমাদের পোশাক যায় তবে সেটা তুলনামূলক কম।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য মতে, গত অর্থবছরে রাশিয়ায় ৫৯৩.৫৫ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে শুধু নিটওয়্যার পণ্য ছিল ৩৭৩.২৫ মিলিয়ন ডলারের। বাকিগুলো ওভেন পণ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু রাশিয়া কিংবা ইউক্রেন নয়, আশেপাশের অনেক দেশেই বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি হয়ে থাকে। যুদ্ধের প্রভাব সেসব দেশের ওপরও পড়ছে। তাই সেসব দেশেও পোশাকের বাজার হারানোর শঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া যুদ্ধ ইতিমধ্যে জ্বালানি তেল এবং তুলার দামে প্রভাব ফেলেছে। এতে পোশাকের কাঁচামালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে পোশাক খাতে।
ইপিবি’র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে চলতি অর্থ বছরের প্রথম ৭ মাসেই ২ হাজার ৩৯৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ আয় গত বছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ের তুলনায় ৩০ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। বেশ কয়েক মাস পর নিটের পাশাপাশি ওভেন পোশাকের রপ্তানিও বেড়েছে। আলোচ্য সময়ে ১ হাজার ৩২৭ কোটি ডলারের নিট পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অন্যদিকে ওভেন পোশাক রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৭১ কোটি ডলারের। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ২৩ শতাংশ।