নারায়ণগঞ্জে একটি ভবনের ফ্ল্যাট থেকে আজ মঙ্গলবার বিকেলে মা–মেয়ের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় এক তরুণ গ্রেপ্তার হয়েছেন। পুলিশ বলছে, জোবায়ের (২৬) নামের ওই তরুণ ভবনটির নিচতলা থেকে প্রতিটি ফ্ল্যাটে কলবেল চাপেন। কিন্তু কেউ দরজা খোলেননি। ছয়তলার ফ্ল্যাটে কলবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দিতেই এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে দুজনকে হত্যা করেন জোবায়ের।
আটক আল জোবায়ের (২৬) নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইকপাড়া এলাকার আলাউদ্দিন মিয়ার ছেলে। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ ঘটনার সময় চিৎকার শুনে আশপাশের ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা ওই ভবনের মূল ফটকে তালা দেন। পরে পুলিশ ভেতরে আটকা পড়া হামলাকারী যুবককে আটক করেছে পুলিশ। তাঁর কাছ থেকে তিনটি ছোরা জব্দ করা হয়েছে।
নিহত দুজন হলেন নগরের পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র নিতাইগঞ্জ ডালপট্টি এলাকার রামপ্রসাদ চক্রবর্তীর স্ত্রী রুমা চক্রবর্তী (৪৬) ও তাঁর মেয়ে ঋতু চক্রবর্তী (২২)। নিহত ঋতু সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ডালপট্টির ৮ নম্বর বি দাস সড়কের ছয়তলা ওই ভবনের নাম ‘মাতৃ ভবন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মঙ্গলবার পৌনে তিনটার দিকে মাতৃ ভবনের ছয়তলার ফ্ল্যাটে অভিযুক্ত জোবায়ের হানা দেন। তিনি ওই ফ্ল্যাটের কলবেল চাপলে রুমা চক্রবর্তী দরজা খুলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গলা চেপে ধরেন এবং ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন। রুমার মেয়ে ঋতু চক্রবর্তী এগিয়ে এলে তাঁকেও এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন।
এ সময় পাশের রুমে থাকা রুমার ছেলের বউ শীলা ঘর থেকে বের হন। জোবায়ের তখন ঘর থেকে বঁটি নিয়ে শীলাকে কোপ দিতে যান। শীলা অভিযুক্ত জোবায়েরকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। এ সময় তাঁর হাতের বঁটি পড়ে গেলে সেটি নিয়ে নিয়ে দৌড়ে প্রাণ বাঁচাতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসেন শীলা। জোবায়েরও তাঁর পিছু পিছু নিচে নামতে থাকলে শীলা তাঁকে বঁটি দেখিয়ে হত্যার হুমকি দেন। তখন জোবায়ের ওই ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন।
রাম প্রসাদ চক্রবর্তী ডালপট্টি এলাকায় ইসলাম স্টোরে বিক্রেতা হিসেবে কাজ করেন এবং ছেলে একটি পোশাক কারখানার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। রাম প্রসাদ চক্রবর্তী বলেন, চিৎকার–চেঁচামেচি ও লোকজনের ভিড় দেখে ফ্ল্যাটে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফটকে তালা বন্ধ থাকায় ভেতরে যেতে পারেননি। তিনি তাঁর স্ত্রীর মুঠোফোনে ফোন করলে জোবায়ের ফোন ধরে বলেন, ‘স্বর্ণালংকার ও টাকাপয়সা কোথায় কী আছে বল, না হলে সবাইকে মেরে ফেলব।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, শীলার চিৎকার শুনে আশপাশের ব্যবসায়ীরা ওই ভবনের নিচের মূল ফটকের দরজা বন্ধ করে দেন এবং পুলিশকে জানান। খবর পেয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল সেখানে যায়। ওই ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে অভিযুক্ত জোবায়েরকে আটক করে। তখন বাসার মেঝেতে নিহত রুমা ও অন্তঃসত্ত্বা ঋতুর লাশ পড়ে ছিল। ঘরের আলমারির মালামাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখেন। ওই সময় ফ্ল্যাটে রুমার স্বামীর রাম প্রসাদ চক্রবর্তী ও তাঁর ছেলে হৃদয় চক্রবর্তী বাড়িতে ছিলেন না।
রাম প্রসাদ বলেন, অভিযুক্ত জোবায়ের তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে আগেই হত্যা করেন। পাশের রুমে গিয়ে তাঁর ছেলের স্ত্রী শীলাকে হত্যার চেষ্টা করলে তিনি সাহসিকতার সঙ্গে বঁটি ধরে ফেলেন এবং ধাক্কা দিয়ে জোবায়েরকে ফেলে দিয়ে নিচে নেমে আসেন। না হলে তাঁর ছেলের বউকেও মেরে ফেলতেন। তিনি বলেন, দুপুরে তিনি বাসায় খেতে যান। এ কারণে হয়তো কলবেলের শব্দ শুনে স্ত্রী দরজা খুলে দেন।
নিতাইগঞ্জ ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শংকর সাহা বলেন, ছয়তলার ফ্ল্যাটের চিৎকার–চেঁচামেচি শুনে তাঁরা ওই ভবনের মূল ফটকের দরজা তালাবন্ধ করে দেন। নিচে এক নারীকে বঁটি হাতে দেখতে পান। পরে পুলিশ এসে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করে। এ ঘটনায় ওই এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কে আছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ঋতু চক্রবর্তীর চট্টগ্রামে বিয়ে হয়েছে। তাঁর স্বামী সেখানে লরির ব্যবসা করেন। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় চট্টগ্রাম থেকে বাবার বাড়িতে এসে থাকছেন। তাঁর ভাই হৃদয় চক্রবর্তী ঢাকার বাড্ডার এলাকার শীলাকে বিয়ে করেছেন। তিন-চার দিন যাবৎ শীলা তাঁদের সঙ্গে থাকছেন।
জোবায়েরের বাবা আলাউদ্দিন মিয়া শহরের টানবাজারের লবণের আড়তদার। তিনি বলেন, জোবায়ের ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। তবে পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় দুটি সেমিস্টার পড়ার পর আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। গত এক-দেড় মাস যাবৎ জোবায়ের কিছুটা উদ্ভট আচরণ করছিলেন। কিছু বললেই উত্তেজিত হয়ে যেতেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জোবায়ের জানিয়েছেন, সে ওই ভবনের নিচতলা থেকে প্রতিটি ফ্ল্যাটের বেল চেপেছেন। কিন্তু কেউ ফ্ল্যাটের দরজা খোলেনি। ছয়তলার ফ্ল্যাটে বেল চাপলে খুলে দিলে তাঁদের হত্যা করেন। জোবায়েরের ভেতরে কোনো অনুশোচনা নেই।নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার (অপরাধ) আমির খসরু বলেন, জোবায়ের কাছ থেকে রক্তমাখা তিনটি ছোরা ও হাতের গ্লাভস উদ্ধার করা হয়েছে। কী কারণে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ জামান বলেন, আটক জোবায়েরের একটি ব্যাগের ভেতরে থেকে ছোট দুটি স্বর্ণের চেইন, কানের দুল উদ্ধার করা হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আলামত সংগ্রহ করে নিয়ে গেছে। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠানো হয়েছে।
ওসি আরও বলেন, ঋতু চক্রবর্তীর পিঠে দুটি এবং হাতে একটি ছোরাবিদ্ধ ছিল।শীলাকে বঁটি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করলে তিনি জোবায়ের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে বঁটি নিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে আসেন এবং সেই বঁটি গেটের বাইরে ফেলার অনেক চেষ্টা করেন। যাতে জোবায়ের তাঁকে হত্যা করতে না পারেন।