অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুতিনের হাতে এক ভয়ংকর অস্ত্র আছে। অস্ত্রটির নাম ‘থার্মোবারিক রকেট’। এটি একটি ভয়ংকর বিধ্বংসী অস্ত্র। ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যদি এই অস্ত্র ব্যবহার করেন, তবে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হবে, তা কল্পনাও করা যায় না।
এটি এক ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র। ক্ষেপণাস্ত্রটি অত্যন্ত বিস্ফোরক জ্বালানি এবং রাসায়নিক মিশ্রণে ভরা। থার্মোবারিক ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরিত হলে যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, তাতে মানুষসহ উঁচু উঁচু ভবন—সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এগুলো অ্যারোসল বোমা বা ভ্যাকুয়াম বোমা নামেও পরিচিত।যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের বোমার নাম দিয়েছে ‘মাদার অব অল বোম্বস’। অন্যদিকে রাশিয়া বলছে ‘ফাদার অব অল বোম্বস’।
সিরিয়া যুদ্ধের সময় ২০১৬ সালে রাশিয়া এই অস্ত্রগুলো ব্যবহার করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এমন অভিযোগ ওঠার পর পোর্টসমাউথ ইউনিভার্সিটির পিটার লি এই বোমাগুলো কীভাবে কাজ করে, তা ব্যাখ্যা করেছিলেন। পিটার লি বলেন, পানির নিচে তলিয়ে যাওয়া একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে কল্পনা করুন। ভাবুন, আপনার শরীর থেকে সমস্ত অক্সিজেন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় আপনি প্রাণপণে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করলেন এবং দেখলেন, আপনার ফুসফুসে ঠান্ডা পানি প্রবেশের পরিবর্তে বিষাক্ত, দাহ্য কণা ঢুকে যাচ্ছে।
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ও অন্যান্য শহরের দিকে যেসব রুশ অস্ত্র যেতে দেখা গেছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে টিওএস-১ নামের ক্ষেপণাস্ত্র, যেটিকে থার্মোবারিক রকেট লঞ্চার বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সাধারণত নির্ভুল হামলার জন্য ব্যবহার করা হয় না। তবে মাটিকে ধসিয়ে দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার পুতিনের রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। রাজধানী কিয়েভসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে তুমুল যুদ্ধ চলছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর মধ্যে। প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটছে। প্রাণ হারিয়েছেন অনেক বেসামরিক মানুষও।
এর মধ্যে ভ্লাদিমির পুতিন এক ভাষণে ইউক্রেনীয়দের অস্ত্র সমর্পণ করতে বলেছেন এবং নিজেদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে বলেছেন। পুতিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘আমাদের যদি কেউ থামানোর চেষ্টা করে এবং আমাদের জন্য আরও হুমকির সৃষ্টি করে, তবে তাদের জেনে রাখা উচিত যে, আমরা তাদের এমন পরিণতির দিকে নিয়ে যাব, যা তারা ইতিহাসে কখনো দেখেনি।’ এমন হুঁশিয়ারির পরই মূলত এই প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে যে, পুতিন কি তবে ইউক্রেনে ফাদার অব অল বোম্বস ব্যবহারের ইঙ্গিত দিলেন?
এমওএবি বা ম্যাসিভ অরডিন্যান্স এয়ার ব্লাস্ট বোমার ধারণাটি আসে ভিয়েতনাম যুদ্ধে ব্যবহৃত ‘বিএলইউ-৮২’ নামের বোমা থেকে। ২০০৩ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্র এটি তৈরি করেছিল ইরাক যুদ্ধে ব্যবহারের উদ্দেশে। ওই বছরের ১১ মার্চ ফ্লোরিডায় পরীক্ষামূলকভাবে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল।
এর বেশ কয়েক মাস পর আরেকটি পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটানো হয় এবং সফলভাবে পরীক্ষা শেষ হয়। তবে ইরাক যুদ্ধে এই বোমা ব্যবহার করেনি যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৭ সালের এক হিসাবমতে, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর হাতে ২০টি মাদার অব অল বোম্বস রয়েছে।
বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এমওএবি নামের এই বোমা তৈরি করতে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছিল প্রায় ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কলমের মতো দেখতে এই অপারমাণবিক বোমার ওজন ১০ টনের কিছু কম এবং এর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ২ মিটার বা ৩০ ফুট।
২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানের সীমান্তঘেঁষা আফগানিস্তানের নানগড়হার প্রদেশের আচিন জেলায় আইএস জঙ্গিদের এক ঘাঁটিতে বোমা নিক্ষেপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এটা এতই শক্তিশালী বোমা ছিল যে, এক হামলাতেই চারজন আইএস কমান্ডারসহ ৯৪ জন জঙ্গি নিহত হয়।
বোমাটির দাপ্তরিক নাম ছিল জিবিইউ-৪৩ /বি ম্যাসিভ অরডিন্যান্স এয়ার ব্লাস্ট বা এমওএবি। তবে পোশাকি নাম হিসেবে একে বলা হয় ‘মাদার অব অল বোম্বস’। মূলত তখন থেকেই মাদার অব অল বোম্বস শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয় বিশ্বব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্র তখন দাবি করেছিল, এটিই তখন পর্যন্ত ব্যবহার করা সবচেয়ে শক্তিশালী অপারমাণবিক বোমা।
ফাদার অব অল বোম্বসের প্রাযুক্তিক নাম থার্মোবারিক ওয়েপনস। এটি বিস্ফোরিত হয় দুই ধাপে। ওজনের দিক থেকে এটি যুক্তরাষ্ট্রের বোমার চেয়ে কম—সাত টনের কিছু বেশি। তবে এটি মাদার অব অল বোম্বসের চেয়ে বেশি বিধ্বংসী বলে দাবি করেছে রুশ সেনাবাহিনী। তাদের মতে, এফওএবির বিস্ফোরক ধারণক্ষমতা প্রায় ৪৪ টন, যেখানে এমওএবির ধারণক্ষমতা ১১ টন।
২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের মাদার অব অল বোম্বস নিক্ষেপের পরদিন রাশিয়া জানায় তাদের কাছে আছে ‘ফাদার অব অল বোম্বস’। এটি যুক্তরাষ্ট্রের বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০০৭ সালে রাশিয়া প্রথম ফাদার অব অল বোম্বসের পরীক্ষা চালিয়েছিল। রুশ সেনাবাহিনী বলেছিল, মাদার অব অল বোম্বসের চেয়ে চার গুণ বেশি শক্তিশালী তাদের ফাদার অব অল বোম্বস।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর একই ধরনের শক্তিশালী অপারমাণবিক বোমা তৈরি করেছে চীন। তবে চীনা প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা এটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বোমার চেয়ে আকারে ছোট ও হালকা বলে দাবি করছেন। একই ধরনের বোমা তৈরি করেছে ভারত ও পাকিস্তান। তবে কোনো দেশই তাদের অপারমাণবিক বোমাকে এমওএবি কিংবা এফওএবির সঙ্গে তুলনা করেনি।