দেশে চালের উৎপাদন, বিপণন, গুদামে মজুত, আমদানি সবকিছুতেই এবার রেকর্ড হয়েছে। জুন পর্যন্ত চাহিদার তুলনায় খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকছে। এরপরও গত বছরের তুলনায় এবার দাম অনেক বেশি বেড়েছে।উৎপাদন ও সরবরাহ বেশি থাকলে পণ্যের দাম কমে-অর্থনীতির এ নিয়ম চালের ক্ষেত্রে উলটো। অনুসন্ধানে জানা গেছে, চালের বেশিরভাগই চলে গেছে সিন্ডিকেটের কব্জায়। এর সঙ্গে রয়েছে মৌসুমি ব্যবসায়ী, মিলার, আড়তদার, পাইকার, অনলাইন ব্যবসায়ীসহ কিছু প্রতিষ্ঠান।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে গত এক বছরে চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। বেসরকারি হিসাবে বেড়েছে ১৪ শতাংশ।গত বছরের এ সময়ে মিনিকেট চাল ছিল ৫৮ টাকা কেজি। এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৬ টাকা কেজি। প্রতিবছর ভর মৌসুমে চালের দাম কেজিতে ৩ থেকে ৫ টাকা পর্যন্ত কমে। এবার কমেনি। বরং বেড়েছে।
আড়তদার, পাইকাররা সবাই ধান কিনে চাল মজুত করেছেন। নিজেদের গ্রাহকদের চাহিদামতো বাড়তি দামে সরবরাহ করছেন। এতে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় একটি পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ চলে এসেছে। ফলে তারা পরিকল্পনামাফিক চালের দাম বাড়াতে পারছেন।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে ৪ কোটি ৪ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৫০ লাখ টন। এর বিপরীতে উৎপন্ন হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ টনের বেশি।
অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ লাখ টন বেশি পাওয়া গেছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ২৯ লাখ টন। আউস ও বোরো বাবদ জুনের মধ্যে আরও আড়াই কোটি টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। একই সময়ে সাড়ে ৪ লাখ টন চাল আমদানির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় বাজারে চালের দাম অনেক বেশি।
তবে দাম কেন বাড়ল সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সেটা যদি ধান মজুতের কারণে হয় তবে তা বন্ধ করতে অধিদপ্তরের একাধিক টিম কাজ করছে। কোনো অসঙ্গতি থাকলে অসাধুদের বের করে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
গত অর্থবছরের উদ্বৃত্ত হয়েছে ৩০ লাখ টন। এসব মিলে চলতি অর্থবছরে খাদ্যের সরবরাহের লাইনে আছে ৪ কোটি ৬৮ লাখ টন। চলতি অর্থবছরে চালের চাহিদা রয়েছে সাড়ে ৩ কোটি টন। এ হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকছে ১ কোটি ১৮ লাখ টন।
আগে কখনোই এত বেশি চাল উদ্বৃত্ত হয়নি। এত চাল উদ্বৃত্ত থাকার পরও কেন চালের দাম বাড়ছে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, জনসংখ্যার প্রকৃত তথ্য ধরে হিসাব করলে উদ্বৃত্ত এত নাও থাকতে পারে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি হিসাবে চালের উৎপাদন, আমদানি, মজুত ও সরবরাহ বাড়লেও এগুলো এখন আর বাজার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারছে না। মাঠ থেকে ধান উঠার পরই কৃষক তার খাদ্য ও বীজ বাবদ কিছু রেখে বাকি ধান বিক্রি করে দেন।
সেগুলোর বেশিরভাগই কিনে নেন মৌসুমি চাল ব্যবসায়ী, মিলার, আড়তদার, পাইকার, অনলাইন ব্যবসায়ীসহ কিছু প্রতিষ্ঠান। তারা এগুলো মজুত করেছেন। পরে গ্রাহকদের চাহিদামতো কিছু বাজারজাত করছেন বাড়তি দামে।
বাকিগুলো মজুত রেখেছেন আরও দাম বাড়লে বাজারে ছাড়বেন-এই আশায়। ফলে এখন যারা চাল বাজারজাত করছেন তারা নিজেদের মতো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। ফলে চালের দাম বাড়ছে। এমন কি ভরা মৌসুমেও চালের দাম বেড়েছে ওই কারণে।
সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৩ কোটি ৮৭ লাখ টন। চলতি অর্থবছরে ৪ কোটি ৪ লাখ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ লাখ টন বেশি আমন উৎপাদন হয়েছে।
জুন পর্যন্ত বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কোনো আশঙ্কা নেই। এ কারণে আউস ও বোরোর উৎপাদনও ভালো হবে।গত অর্থবছরের এ সময় চাল আমদানি করা হয়েছিল ২৬ লাখ টন। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ৩ লাখ টন বেশি আমদানি হয়েছে। গত অর্থবছরের এ সময়ে সরকারি ক্রয় নীতির আওতায় কেনা হয়েছিল ৬ লাখ টন।
রাজধানীর বাদামতলী, কৃষি মার্কেট, কাওরান বাজার চালের আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোথাও চালের সরবরাহ ও মজুতে কোনো ঘাটতি নেই। মিলারদের কাছে আদেশ দেওয়ার ২-৩ দিনের মধ্যেই ট্রাকভর্তি চাল আসছে। খুচরা বাজারেও কোনো ঘাটতি নেই।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. ইউসুফ সম্প্রতি একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেছেন, খাদ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধিরা চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধান ও চালের মজুত নিয়ে মাসিক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন।
এটি সঠিকভাবে করা উচিত। এটা থেকে তারা দূরে আছেন। আমার মনে হয় মাসে চালকলগুলোতে যে পরিমাণ মজুত আছে সেটার সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ করে সঠিক তথ্য নিয়ে খাদ্য অধিদপ্তরকে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে-সমস্যাটা কোথায়। তা বের করে সমাধান করতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। করোনার কারণে প্রায় সব ধরনের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একমাত্র চালের ব্যবসায় ক্ষতি হয়নি। বরং চাঙ্গা হয়েছে। মুনাফাও বেড়েছে।
আগে মিলার ও আড়তদাররা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ধান মজুত করতেন। ফলে তারা ব্যাংকের টাকা বিনিয়োগ করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে এ ঘটনা প্রমাণিত হওয়ায় এ খাতে ঋণ বিতরণে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
রাজধানীর কাওরান বাজারের আল্লাহর দান রাইস এজেন্সির মালিক সিদ্দিকুর রহমান বলেছেন, ধান নিয়ে প্রতিবছরই কারসাজি হয়। এ বছর কারসাজির চিত্র ভিন্ন। আগে মিলারদের কাছে ধান মজুত থাকত। এবার শুধু মিলার নয়, অনেকের কাছেই ধান মজুত আছে। মিলারদের সঙ্গে মৌসুমি ধান ব্যবসায়ী, বড় বড় অনেক কোম্পানি ধান ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
এছাড়া কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনেছে। যে কারণে ধানের বাজারে মিলারদের একচেটিয়া প্রভাব কমলেও অনেকের হাতে ধান চলে যাচ্ছে। তারাই মূলত কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। যে কারণে চালের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তাই সঠিক জায়গায় প্রশাসনকে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। তাহলেই ধান বের হবে। তা না হলে ধান বের হবে না।
এদিকে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার একটি আইন করেছে। নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি চাল মজুত করতে হলে লাইসেন্স নিতে হবে। এখন অনেকেই লাইসেন্স নিয়ে যেমন মজুত করছে, তেমনি লাইসেন্স ছাড়াও করছে। ফলে ধান বা চালের উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহের তথ্য সরকারের কাছে থাকলেও বেসরকারি পর্যায়ের তেমন তথ্য নেই।
বাংলাদেশ অটোরাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম খোরশেদ আলম খান বলেছেন, বেসরকারি ভাবে কার কাছে কত ধান মজুত আছে সে তথ্য বের করতেই হবে। কোথায় ধান মজুত আছে ও কেন ধান মজুত আছে এটা সরকার সংশ্লিষ্টদের দেখতে হবে।
তাহলেই চালের দাম কেন বাড়ছে তার কারণ জানা যাবে।তিনি আরও বলেন, সরকারি গুদামে এখন অনেক চাল মজুত আছে। তারপরও দাম কমছে না। সরকারের কাছে মজুত বেশি থাকলে দাম সাধারণত কমে যায়। এবার তেমনটা হচ্ছে না।