গল্পটা হতে পারত সৈকত আলীর। দলে ফিরে ৩৪ বলে ৫৮ রানের ইনিংসে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসকে ম্যাচ থেকে প্রায় ছিটকে ফেলেছিলেন তিনি। গল্পটা হতে পারত সাকিব আল হাসানেরও, গোটা টুর্নামেন্টে বরিশালকে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে, ফাইনালেও বোলিং আর অধিনায়কত্বে দেখিয়েছেন ঝলক।তবে গল্পটা তাঁদের কারও না।
গল্পটা ইমরুল কায়েসের, এক্সট্রা কাভার থেকে ম্যাচের শেষ বলে থ্রো করে যিনি রানআউট করলেন মুজিব উর রেহমানকে। কুমিল্লা আর বরিশালের মধ্যে পার্থক্য হয়ে গেল ১ রানের।মিরপুরের রোমাঞ্চকর আর ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো ম্যাচে গল্পটা তাই কুমিল্লার। প্রত্যাবর্তনের অসাধারণ গল্প লিখে বরিশালকে হারিয়ে অষ্টম বিপিএলের শিরোপা জিতল ইমরুল কায়েসের দল, ২০১৫ ও ২০১৯ সালের পর তৃতীয়বারের মতো।
গল্পটা সুনীল নারাইনের, ২৩ বলে ৫৭ রানের ইনিংসের পর ৪ ওভারে ১৫ রানে নিয়েছেন ২ উইকেট। গল্পটা মঈন আলী ও আবু হায়দারের। নারাইনের দুর্দান্ত ইনিংসের পরও হুট করে কোণঠাসা কুমিল্লাকে তাঁরা সপ্তম উইকেটে এনে দেন ৫১ বলে ৫৩ রানের জুটি, তাতে কুমিল্লা পায় লড়াই করার মতো স্কোর।
১৫২ রানের লক্ষ্য ফাইনালে, সহজ হওয়ার কথা অবশ্য ছিল না। প্রথম ওভারে মোস্তাফিজের ৪ ওয়াইডের পরও ৪ রান, পরের ওভারে শহীদুল ইসলামের বলে টেনে মারতে গিয়ে মিড-অনে মুনিম শাহরিয়ারের ক্যাচ—ফাইনালের রান তাড়ার চাপ ভালোভাবেই পেয়ে বসেছিল বরিশালকে। তবে গল্পটা বদলে দিয়েছিলেন সৈকত আলী এসে।সে ওভারেই শহীদুল ইসলামকে মারলেন টানা ৩ চার। সুনীল নারাইনের বলে এরপর এলবিডব্লু দিয়েছেন তাঁকে আম্পায়ার, তবে সঙ্গে সঙ্গেই নেওয়া এডিআরসে বেঁচে যান বল ব্যাটে লেগেছিল বলে।
অবশ্য রান তাড়ায় এ ম্যাচটা বরিশাল কীভাবে হারল, সেটি হতে পারে গবেষণার বিষয়। ৮ উইকেট রেখে ৪৮ বলে তাদের প্রয়োজন ছিল ৫০ রান। শেষ ১৮ বলেও ৫ উইকেট হাতে রেখে প্রয়োজন ছিল ১৮ রান। তবু কুমিল্লার কাছে কোনো একভাবে হারের পথটা বের করে নিল সাকিবের দল! আর তাই আশা না ছেড়ে শেষ পর্যন্ত উল্লাসে মেতেছে কুমিল্লাই।
ছন্দপতন হয়নি সৈকতের, ঠিক পরের বলেই চার মেরে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সেটিই। সৈকতকে এরপর থামাতে পারেননি মোস্তাফিজও, উল্টো তাঁর বলেও টানা ৩টি চার মেরেছেন এ ডানহাতি। পাওয়ারপ্লের শেষ ওভারে আসা মঈনকে চার-ছয়ে আগ্রাসী ভাব ধরে রাখেন সৈকত, প্রথম ৬ ওভারে বরিশাল তোলে ৫১ রান।
পাওয়ারপ্লের পরও সৈকত থামেননি। তৃতীয়বারের মতো ১ ওভারে এবার ৩ চার মারেন আবু হায়দারকে, এবারের বাউন্ডারিগুলো ছিল টানা। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি দিয়ে অর্ধশতক পূর্ণ হয়ে যায় তাঁর, মাত্র ২৬ বলেই।সৈকতকে থামান তানভীর ইসলাম, তুলে মারতে গিয়ে লং-অনে ইমরুল কায়েসের হাতে ধরা পড়েন তিনি। এর আগে ইনিংসে ফুল লেংথে পেলে ড্রাইভ করতে আজ ভুল হয়নি সৈকতের, জায়গা পেয়ে কাটও করেছেন দারুণভাবে।
এর আগে টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়া ইমরুলের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন নারাইন, আগের ম্যাচে যেখানে শেষ করেছিলেন, আজ সেখান থেকেই শুরু করে। মুজিব উর রেহমানের প্রথম ওভারের পর শফিকুল ইসলামের করা প্রথম ২ ওভারেই ওঠে ১৮ করে রান। জায়গা পেলে তো কথাই নেই, নারাইন জায়গা বানিয়ে নিয়েও খেলেছেন শট।
ঠিক স্বরূপে অবশ্য আজও ফেরা হয়নি গেইলের, নারাইনের বলে ব্যাকফুটে গিয়ে খেলতে গিয়ে হয়েছেন এলবিডব্লু, বাঁচেননি এডিআরএস নিয়েও। অবশ্য আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে ঠিক সন্তুষ্ট মনে হয়নি তাঁকে। এরপর তানভীর ইসলামের বলে মোস্তাফিজের দারুণ ক্যাচে পরিণত হন সাকিব, কুমিল্লাও আশা পায় নতুন করে।
এক্সট্রা কাভার, কাউ কর্নার, লং অন—নারাইনের শট গেছে সব দিকেই। নারাইন-ঝড় থামাতে এসে তৃতীয় ওভারে লিটনকে ফেরান সাকিব। তাঁর ঝুলিয়ে দেওয়া বলে স্লগ করতে গিয়ে মিস করে বোল্ড হন লিটন, ৬ বলে ৪ রান করেই। দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারের মতো ফাইনালেও ব্যর্থ হলেন লিটন।
টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান মঈনের সামনে তখন দ্রুত উইকেটের চাপ সামাল দেওয়ার সঙ্গে রান তোলার দ্বিমুখী চ্যালেঞ্জ। আবু হায়দারকে নিয়ে অবশ্য জুটিটাই গড়েছেন। শেষ দিকে একটু আক্রমণ করেছেন দুজন, তবে ব্রাভোরা ঠিকমতো হতে দিচ্ছিলেন না। ৩২ বলে ৩৮ রান করে মঈন ফেরেন শেষ ওভারের প্রথম বলেই। শফিকুলের করা ওই ওভারে ৩ উইকেট হারিয়ে ২ রান তোলে কুমিল্লা।তবে গল্পের সেটিই শেষ নয়। গল্পটা যে কুমিল্লারই।