ফেসবুকেই পরিচয়। একে একে মন দেয়া-নেয়া। একপর্যায়ে প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া। কিছুদিনের মধ্যেই একান্ত সময় কাটাতে প্রেমিকার বাসায় যাওয়ার পর থেকে উল্টে যেতে থাকে পিরামিড। পুলিশরূপী কোনো ব্যক্তির আগমন। সবশেষে মানসম্মান রক্ষায় তাদের চাহিদা পূরণ করেই মুক্তি মেলে প্রতারণার শিকার প্রেমিকের।
স্ত্রীকে দিয়ে ফাঁদে ফেলে বাসায় ডেকে বেডরুমে নিয়ে করাতেন আপত্তিকর কাজ। স্ত্রী ও বিভিন্ন মেয়েদের নাম দিয়ে খোলা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণ করতেন নাসিমার স্বামী টুটুল। এরপর মধ্যবয়সী ব্যক্তিদের টার্গেট করে নারী পরিচয়ে কথা বলা শুরু হয়। ফেলা হয় প্রেমের ফাঁদে।
একপর্যায়ে ভিডিও কলে স্ত্রীকে ব্যবহার করে কথা বলানো হয় ফাঁদে ফেলা ব্যক্তিদের সঙ্গে। একান্তে সময় কাটাতে ডেকে আনা হয় বাসায়। এরপরই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। সেই ব্যক্তিকে বাসায় এনে আপত্তিকর অবস্থায় ফেলে ব্ল্যাকমেইল করতেন স্বামী টুটুল ও তার দুই সহযোগী।
অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ধারণ করার কারণে দিনের পর দিন চলতে থাকে প্রতারক চক্রের ব্ল্যাকমেলিং। এমন একটি অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়েই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের গুলশান বিভাগ খুঁজে পায় ভয়ংকর এই গ্যাংকে। শনিবার রাজধানীর মুগদা ও বাড্ডা থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় প্রতারক দম্পতি মো. টুটুল ও নাসিমা আক্তার এবং তাদের সহযোগী মো. মোশারফ হোসেন শুভ ও আবজল মিয়াকে।
জানা গেছে, টুটুল-নাসিমা দম্পতি মিলে তৈরি করেছিল প্রতারণার সাম্রাজ্য। তাদের বাসা বাড্ডা এলাকায়। ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে মধ্যবয়সী মানুষকে প্রেমের ফাঁদে ফাঁসাতেন নাসিমা। এরপর সেই ব্যক্তিকে বাসায় এনে আপত্তিকর অবস্থায় ফেলে ব্ল্যাকমেইল করতেন টুটুল ও তার দুই সহযোগী। ২০১৮ সাল থেকে নিয়মিত তারা এমন প্রতারণা করে আসছিলেন।
এ চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার অন্তত ৩০ জন। ডিবি গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান বলেন, ‘টুটুল অপকর্মের জন্য স্ত্রীকে ব্যবহার করতেন। মধ্যবয়সী প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের টার্গেট করতো ওরা। ভুক্তভোগীরাও তাদের ফাঁদে পা দিতেন একটু বাড়তি মজা নেয়ার জন্য। তবে আমরা অতীতের মতো আবারও অনুরোধ করবো, যাচাই-বাছাই না করে কারো ফাঁদে পা দেবেন না।’
সম্প্রতি এভাবেই এই চক্রের কাছে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়েছেন একটি বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। ইতিমধ্যে তিনি প্রতারকদের পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন। তাকে আরো পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে আসছিলো তারা। এ ধরনের আরো একটি ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় এই চক্রের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে।
তারা নিজেদের পরিচয় দিতেন পুলিশ বা সাংবাদিক হিসেবে। ধারণ করে রাখা হতো ভিডিও। এরপর ব্ল্যাকমেইল করে হাতিয়ে নেওয়া হতো মোটা অঙ্কের টাকা।ব্ল্যাকমেইল করার কৌশল বর্ণনা করে টুটুল পুলিশকে জানান, কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে আসার পর আমরা তাকে বলতাম, এটা কি আপনি ভালো কাজ করেছেন নাকি খারাপ? আপনার বাসা কোথায়। তখন তিনি বলতেন, খারাপ কাজ হয়েছে। অন্যায় হয়েছে। তিনি স্বীকার করে আমাদের কাছে মাফ চাইতেন।
আমরা বলতাম, আপনি যে এই খারাপ কাজ করতে আসছেন, আপনার বাসায় এটা আমরা বলে দেব। এরপর তিনি বলতেন, আমার মানইজ্জত নষ্ট না করতে। তারপর কিছু টাকা দিত এবং আমরা এটা নিতাম।সম্প্রতি এভাবেই ব্ল্যাকমেইলের শিকার হন নৌবাহিনীর সাবেক এক কর্মকর্তা। তাকে দিতে হয় ৫ লাখ টাকার বেশি।
ডিসি মশিউর বলেন, প্রতারকরা ধারণ করা ভিডিও ভিকটিমের পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তার কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। ভিকটিম টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে মারধর করে এবং তার কাছে থাকা নগদ টাকা, মোবাইল, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ড এবং কার্ডের পিন নম্বর নিয়ে নেয়। এ ছাড়া ভিকটিমের পরিবারের সদস্যদের ফোন করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর জন্য চাপ দেয়। ভিকটিম আত্মসম্মানের ভয়ে তাদের সব দাবি মানতে বাধ্য হন।