লাগামহীন নিত্যপণ্যের দামে দিশেহারা সাধারণ মানুষ

দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য বাজারের বাড়তি খরচ যেন গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, ডিম ও মাংসসহ একে একে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। সরকারের হিসাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে।

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে এখনো স্বাভাবিক আয়ে ফিরতে পারেননি দেশের বেশিরভাগ মানুষ। উপরন্তু সঞ্চিত অর্থেও টান পড়ছে। অন্যদিকে বাজারে লাগাতার বাড়তে থাকা জিনিসপত্রে দাম স্বস্তি দিচ্ছে না কাউকে। উচ্চমূল্যের এই বাজারে খাবারের খরচ জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছে সীমিত ও স্বল্পআয়ের মানুষ।

গতকাল জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী পরিষদের (একনেক) সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান জানান, বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ৫৯১ ডলার হয়েছে, দেশীয় মুদ্রায় যা ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৩৮ টাকা।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাথাপিছু আয় কিংবা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের আয় যে পরিমাণে বেড়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। প্রতিদিনের রান্নায় দরকার হয় এমন সব পণ্য কিনতেই নাভিশ্বাস উঠেছে ভোক্তাদের।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও এলপিজি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও।বাজার পর্যবেক্ষকরাও বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ঘুরেফিরে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যের কথাই উঠে আসছে।

ভোজ্যতেলসহ খাদ্যসামগ্রীর দাম নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়েছেন ঐক্য ন্যাপের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা পঙ্কজ ভট্টাচার্য, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ও রাশেদা কে চৌধুরীসহ দেশের ২৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক।

গতকাল প্রকাশিত এক যৌথ বিবৃতিতে তারা জানান, প্রায় ২ বছর ধরে করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সীমাহীন আর্থিক দুরবস্থায় নিমজ্জিত। এমন পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্য, বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রীর দাম ক্রমাগত বাড়ছে। নতুন করে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের জীবন আরও কষ্টকর হয়ে উঠবে।

তারা আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বাজারব্যবস্থায় একটি দুষ্টচক্র তথা সিন্ডিকেটের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এই সিন্ডিকেট বিভিন্ন সময়ে মজুদ ও কৃত্রিম সংকট এবং বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে দাম বাড়িয়ে সাধারণ ভোক্তার কষ্টার্জিত অর্থ হাতিয়ে নেয়। এ ধরনের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠলেও কখনই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘বাজারে প্রতিটি প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। পণ্যের মূল্য বেঁধে দেওয়া, আমদানি বাড়ানো, বাজার তদারকি জোরদারসহ সরকারের নানা উদ্যোগ থাকলেও তা কাজে আসছে না। আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা ও নজরদারিতেই গলদ রয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে খুব একটা কাজ হয় না। আমাদের পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক কিংবা স্বাভাবিকের কাছাকাছি রাখতে হবে।’

খুচরা বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বাজার নিয়ন্ত্রণ হয় না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘এতে খুচরা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন মাত্র। অভিযান চালাতে হবে আড়ত, হিমাগার ও পাইকারি বাজারগুলোতে। পণ্যের মজুদ ও সরবরাহের হিসাবও থাকতে হবে সরকারের কাছে। পাশাপাশি আমদানিনির্ভরতা কাটিয়ে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। এর বিকল্প নেই। এটাই টেকসই সমাধান। নইলে বারবার বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে।’

ভোক্তাদের মাথাব্যথার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভোজ্যতেল। চার মাস পার হতে না হতে আবারও সয়াবিন তেলের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গত ৬ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে খোলা প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৪৩ টাকা এবং বোতলজাত সয়াবিন তেলে ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৬৮ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। এ ছাড়া পাঁচ লিটারের বোতলে ৩৫ টাকা বাড়িয়ে ৭৯৫ টাকা করা হয়েছে। পাম তেলে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ১৩৩ টাকা করা হয়েছে।

বাজারে মসুর ডালের দামও হু হু করে বেড়েছে। রাজধানীর বাজারে মোটা দানার মসুরের দাম বেড়ে এখন ১০০ টাকায় ঠেকেছে। ১৫ দিন আগেও যা ৯৫ টাকায় পাওয়া গেছে। ছোট দানার মসুর ডালের কেজি এখন ১০৫ টাকা থেকে বেড়ে ১১৫ টাকা হয়েছে। প্রতিকেজি খোলা চিনি ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা এবং প্যাকেট চিনি ৮৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

রাজধানীসহ পাঁচ জেলার বাজারচিত্র বলছে, সব ধরনের পণ্যের দামই বাড়ছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবও বলছে, বছরের ব্যবধানে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম অনেক হারে বেড়েছে।

টিসিবির নিয়মিত তথ্য পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় দশটি পণ্যের (চাল, ডাল, আটা, খোলা সয়াবিন তেল, চিনি, আদা, ব্রয়লার মুরগি, ফার্মের ডিম, গুঁড়া দুধ ও গরুর মাংস) মূল্যবৃদ্ধির হার হিসাব করে দেখা গেছে, গত বছরের (২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি) তুলনায় এ বছর (২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি) এসব পণ্যের দাম ১৯ দশমিক ৩০ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে এসব পণ্য কেনায় ভোক্তার গড় খরচ বেড়েছে ১৯ শতাংশেরও বেশি। খরচ বাড়ায় এসব পণ্যের অনেকগুলোই বাজার তালিকা থেকে বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন ভোক্তারা।

টিসিবি ও বাজারদরের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এক বছরের ব্যবধানে চিকন চালের দাম ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং মোটা চালের দাম ৩ দশমিক ২৬ শতাংশ বেড়েছে। খোলা আটা ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ ও প্যাকেটজাত আটার দাম ২৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেড়েছে। প্যাকেট ময়দার দামও ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেড়েছে।

দীর্ঘসময় ধরে মানুষকে ভোগাচ্ছে চালের বাজার। দুই বেলার জন্য মোটা চাল কিনে খেতেও গরিবের কষ্ট হচ্ছে। গত বছরের শেষদিকে ৪৮ টাকার মধ্যে কেনা গেলেও বর্তমানে রাজধানীর বাজারে ভালো মানের মোটা চাল ৫০ টাকার নিচে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজধানীর খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে চিকন চালের দাম কেজিতে নতুন করে ২ টাকা বেড়েছে।

প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলে ২৩ শতাংশ, খোলা সয়াবিন তেলে ২৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং পাম তেলে ৩০ দশমিক ১৯ শতাংশ দাম বেড়েছে। এক বছরে মসুর ডাল (মোটা দানা) ৪৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ, চিনি ১৪ দশমিক ৮১ শতাংশ, আদার দাম ২২ দশমিক ২২ শতাংশ বেড়েছে। ফার্মেরর ডিমের দাম এক বছরে ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়েছে। গরুর মাংসের দাম ১৩ শতাংশ বেড়েছে এবং ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। গুঁড়া দুধের দামও এক বছরে ব্র্যান্ডভেদে ২ দশমিক ৬৫ থেকে ৭ দশমিক ২১ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

গরুর মাংসের দাম অনেক আগেই সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইলে চলে গেছে। নতুন করে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজি ৪০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৬২০ টাকায়। কোথাও কোথাও ৬৫০ টাকাতেও বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। এর আগে দীর্ঘসময় ধরে গরুর মাংসের কেজি বিক্রি হয় ৫৮০ থেকে ৬০০ টাকা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্যের মূল্য নির্ধারণ কিংবা খুচরা বাজারে তদারকি অভিযান একেবারেই অকার্যকর। আমাদের আসল সমস্যা সরবরাহে। দেশে পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের পরিসংখ্যানে অনেক ত্রæটি রয়েছে। আমাদের উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহের পরিসংখ্যানে পরিষ্কার তথ্য নেই। আগে এ তথ্যগুলো পরিষ্কার করতে হবে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে।’

এ বছর শীতের হাওয়াও ঠান্ডা করতে পারেনি সবজির বাজার। বাজারে এখনো চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে সব ধরনের সবজি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে রাজধানীতে সবজি এনে বিক্রি করতে দাম বেড়ে যাচ্ছে।

Exit mobile version