৭৬ বছর বয়সী খালেদা জিয়া বেশ কয়েক বছর ধরে আথ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, দাঁত–চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। গত বছর এপ্রিলে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রায় দুই মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর বাসায় ফেরেন।
পরবর্তীতে দীর্ঘদিন চিকিৎসা শেষে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলেও তাঁর শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলেছেন, লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়া আপাতদৃষ্টে স্থিতিশীল আছেন। তবে শিগগিরই আবার অসুস্থ হয়ে পড়বেন না এমন নিশ্চয়তা নেই।
করোনা ভাইরাস থেকে সুস্থ হতেই কয়েক মাস না যেতেই তাঁর অসুস্থতা বেড়ে যায়। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে গত বছর ১৩ নভেম্বর তাঁকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বেশ কিছুদিন আইসিইউতে রেখে তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বিএনপি নেতারা অনেকবার নেত্রীর জীবনাশঙ্কা প্রকাশ করে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন। তবে বিএনপি নেতাদের ওই আবেদনে সাড়া দেয়নি সরকার।
খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক শামসুল আরেফিন বলেন, তাঁর অবস্থা সংকটপূর্ণভাবে স্থিতিশীল, তবে তিনি সুস্থ নন। হাসপাতালে করোনা পরিস্থিতির কারণে তিনি বেশ ঝুঁকিতে। সে জন্য আপাতত তাঁকে বাসায় পাঠানো হচ্ছে। তিনি রোগমুক্ত নন।
টানা ৮১ দিন চিকিৎসার পর আজ সন্ধ্যার পর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসায় ফিরলেন খালেদা জিয়া। তিনি বাসার উদ্দেশে যাত্রা করার আগে সন্ধ্যা সাতটার দিকে এভারকেয়ার হাসপাতালের ১১তলার মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে আসেন চিকিৎসকেরা। সেখানে ওই হাসপাতালের চিকিৎসকদের পাশাপাশি খালেদার চিকিৎসায় সম্পৃক্ত বিএনপিপন্থী চিকিৎসকেরা ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসক বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী বলেন, এভারকেয়ার হাসপাতালের ৩৮০ জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এই অবস্থায় খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই মুহূর্তে তাঁর অবস্থা একটু স্থিতিশীল হওয়ায় তাঁকে বাসায় রেখে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমণে যদি তাঁর আবার জটিলতা তৈরি হয়, তখন চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আরও কঠিন হবে। সে জন্য তাঁকে হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী বলেন, খালেদা জিয়ার অসুখের যে কনসিকোয়েন্স, তা হলো ‘হাই প্রেসার পোর্টাল সার্কুলেশন’। সেটার জন্য বাইপাস ড্রেন তৈরি করে দিতে হয়, কিন্তু সেটা করা যায়নি। দৃশ্যমান বড় যে ভেসেলগুলো (শিরা) ফেটে যাচ্ছিল, সেগুলোর কিছু ব্লক করা হয়েছে।
লিভারে সংক্রমণের কারণে খালেদা জিয়ার শরীরে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি বলে জানান অধ্যাপক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘খুব ছোট আকারে এখনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তিনি আপাতদৃষ্টে স্থিতিশীল আছেন। তবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই যে অদূর ভবিষ্যতে আবারও রক্তক্ষরণ হবে না।’
চিকিৎসকেরা জানান, খালেদা জিয়া গত অক্টোবরে যখন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, সে সময় তাঁর মেডিকেল পরীক্ষায় টিউমার শনাক্ত হয়েছিল। এই টিউমার প্রাথমিক পর্যায়ে থাকায় তাঁকে একটা মেডিকেল বোর্ডের অধীনে রেখে সার্জারি করে টিউমারটা বের করা হয়েছে।
এই পর্যায়ে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন বলে জানান অধ্যাপক ফখরুদ্দিন মোহাম্মদ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘তখন তাঁর বেচে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে আমরা এতটাই উদ্বিগ্ন ছিলাম যে সেই ব্যাপার আপনাদের (সাংবাদিকদের) জানানো হয়নি।’
মেডিকেল বোর্ডের আরেক সদস্য অধ্যাপক এ কিউ এম মোহসীন বলেন, ‘আমরা যেটা করেছি, যেখান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, সেটা টার্গেট করে আমরা বন্ধ করেছি। কিন্তু তাঁর লিভারে যে প্রাইমারি হাইপারটেনশন, এটাকে ডাইভার্ট করে দিলে প্রেশার কমে যাবে। প্রাইমারি প্রেশারটা কমানোর জন্য তাঁর বাইরে যাওয়া উচিত।’
খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া প্রয়োজন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে শামসুল আরেফিন বলেন, দেশের প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়াকে যত দূর চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব, দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসক, দেশের বাইরের চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। সবার একই মত, তাঁকে ভবিষ্যতের চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠানো প্রয়োজন।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে খালেদা জিয়ার চিকিৎসক টিমের প্রধান অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান এ জেড এম জাহিদ হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।এই সংবাদ সম্মেলনের পরে খালেদা জিয়া হাসপাতাল থেকে বাসার উদ্দেশে যাত্রা করেন। রাত সাড়ে আটটার দিকে তিনি বাসায় পৌঁছান। খালেদা জিয়ার বাসায় ফেরা উপলক্ষে তাঁর বাসভবনে কর্মরত সবার করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে।