প্রতারণার ৯৫ লাখ টাকাসহ ওই ৭ বিদেশি ও তাঁদের সহযোগী বাংলাদেশি দম্পতিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তাঁরা হলেন নাইজেরিয়ান উদেজে ওবিন্না রুবেন (৪২), ইফুন্যা ভিভিয়ান নাবুইকে (৩১), সানডে শেডেরাক এজিম (৩২), চিনেদু মোসেস নাজি (৩৬), কলিমস ইফেসিনাছি তালিকে (৩০), চিদিম্মা এবেলে আইলোফো (২৬), দক্ষিণ আফ্রিকার এনটোম্বিখোনা গেবুজা (৩৬) এবং তাঁদের সহযোগী মো. নাহিদুল ইসলাম (৩০) ও সোনিয়া আক্তার (৩৩)। তাঁদের কাছ থেকে ৮টি পাসপোর্ট, ৩১টি মুঠোফোন, ৩টি ল্যাপটপ, ১টি চেক বই, ৩টি পেনড্রাইভও উদ্ধার করা হয়েছে।
ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে তৈরি পোশাকের ব্যবসা শুরু করেন নাইজেরিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাত নাগরিক। পরে বাংলাদেশি এক দম্পতির সহযোগিতায় ব্যবসার আড়ালে শুরু করেন অভিনব প্রতারণা। কারও কারও ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করতে থেকে যান বাংলাদেশে।
বিদেশি নাগরিকদের এই প্রতারক চক্রের সদস্যরা ফেসবুক মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো কিংবা ফেসবুকে নিজেদের পশ্চিমা দেশের নাগরিক পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। এরপর তাঁরা বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। দামি উপহার, পার্সেল, অতি মূল্যবান সামগ্রী দেওয়ার কথা বলে আদায় করে নিতেন বিপুল অঙ্কের টাকা।
আজ বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব-৪–এর অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মো. মোজাম্মেল হক এসব তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এর আগে বিভিন্ন সময়ে টাকাকে ডলারে রূপান্তরিত করা এবং পার্সেল পাঠানোর কথা বলে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৫-২০ জন বিদেশি নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছিলেন তাঁরা।
সম্প্রতি তাঁরা আবার তথ্য পান, একই কায়দায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে দামি উপহার পাঠানোর কথা বলে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। এরপর গতকাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে আজ বুধবার সকাল ৭টা পর্যন্ত র্যাব-৪–এর একটি দল র্যাব-৮–এর সহযোগিতায় রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখানে অভিযান চালিয়ে ওই ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে।
র্যাবের পরিচালক মোজাম্মেল হক বলেন, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুকে নিজেদের পশ্চিমা দেশের নাগরিক পরিচয় দিয়ে বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। একপর্যায়ে দামি উপহার বাংলাদেশে পাঠানোর কথা বলে প্রতারণার জাল ছড়িয়ে দেন। উপহার পাঠাচ্ছেন বলে জানানোর কিছুদিন পর তাঁদের এ দেশের নারী সহযোগী বিমানবন্দর শুল্ক কর্মকর্তা (কাস্টমস অফিসার) পরিচয়ে ভুক্তভোগীকে ফোন করে বলেন, তাঁর নামে একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে।
পার্সেলটি সরবরাহ করতে কাস্টমস চার্জ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা বিকাশ বা ব্যাংক হিসাব নম্বরে পরিশোধ করতে হবে। যেহেতু পার্সেলে অতি মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে এবং এভাবে বিদেশ থেকে কোনো পার্সেল দেশে আনা আইনসিদ্ধ নয়, তাই চার্জ একটু বেশি দিতে হবে। নকল টিন সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজ বানাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। কেউ কেউ টাকা না দিতে চাইলে তাঁদের মামলার ভয়ভীতি দেখানো হয়। সরল মানুষ তাঁদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে কখনো মামলার ভয়ে সংশ্লিষ্ট বিকাশ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই প্রতারক চক্রের সদস্যরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মেয়েদের নামে ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন প্রোফাইল ঘেঁটে বড় বড় ব্যবসায়ী, বেশি বেতনের চাকরিজীবীসহ উচ্চবিত্তদের প্রতারণায় ফেলতে ফাঁদ পাততেন। এরপর তাঁদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। তাঁরা ভুক্তভোগীদের কাছে নিজেকে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দেন। ভিকটিমকে বিভিন্ন সময়ে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ভুয়া ছবি পাঠান বিশ্বাস স্থাপনের জন্য। সম্পর্কের একপর্যায়ে বিভিন্নভাবে ভিকটিমকে তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে প্রলুব্ধ করেন।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর প্রতারকেরা জানান, তাঁদের কাছে বিপুল পরিমাণ ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে, কিন্তু তাঁরা তা খরচ বা নিজেদের দেশে নিতে পারছেন না। প্রতারকেরা সেসব মুদ্রা ভুক্তভোগীদের কাছে পাঠাতে চান এবং বলেন, ‘তোমার কাছে রেখে দাও, পরবর্তী সময়ে আমি নেব।’ তাঁরা চাকরিজীবীদের বলেন, তাঁদের দিয়ে জনসেবামূলক কাজে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবেন এবং এতে তাঁরা একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন পাবেন। আর যাঁরা ব্যবসায়ী, তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ে অর্থ লগ্নি এবং তাঁকে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ কমিশন দেওয়া হবে। এতে সহজ–সরল মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে তাঁদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে প্রতারিত হন।
দেশি প্রতারক নাহিদুল ২০০৮ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০১০ সালে একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। পরে রেস্তোরাঁ ও একটি কল সেন্টারে কাজ করেন। ২০১৭ সালে ফ্যাশন ডিজাইনে ডিপ্লোমা করেন। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় গিয়ে ২০২১ সালে দেশে ফেরেন। তিনি গ্রেপ্তার হওয়া সোনিয়া আক্তারের স্বামী।
সোনিয়া ২০০৬ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০০৮ সালে একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত একটি দূতাবাসে ২৫ হাজার টাকা বেতনে চুক্তিতে চাকরি করেন। ২০১৮ সালের শেষের দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নাইজেরিয়ার নাগরিক রুবেনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।
এরপর তিনি এই প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। প্রতারণার কাজে সহযোগিতার জন্য রুবেন ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের ২৫ শতাংশ সোনিয়াকে দিতেন। সোনিয়ার নিজের নামে দক্ষিণখানে একটি চারতলা বাড়ি ও একটি ব্যক্তিগত গাড়ি আছে।
র্যাব কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, গ্রেপ্তার হওয়া সোনিয়া আক্তার ও নাহিদুল ইসলাম এই আন্তর্জাতিক চক্রের এ দেশীয় সহযোগী। তাঁদের মাধ্যমেই এই প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকেরা ভুক্তভোগী সংগ্রহ, বন্ধুত্ব স্থাপন, কাস্টমস অফিসার পরিচয় দেওয়া এবং শেষে অর্থ সংগ্রহ করে আসছিলেন। নাইজেরিয়ার উদেজে ওবিন্না রুবেন ২০১৭ সালে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন এবং ২০২০ সালে তাঁর নামে একটি প্রতারণা মামলা করার পর তাঁর পাসপোর্ট জব্দ করে র্যাব-৪।
তিনি নিজেকে একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে প্রতারণাই তাঁর মূল পেশা। তিনি এই আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের প্রধান। দক্ষিণ আফ্রিকান এনটোম্বিখোনা গেবুজা ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন। তাঁর ভিসার মেয়াদ এ বছরের জুন পর্যন্ত। তিনি নিজেকে রুবেনের স্ত্রী বলে পরিচয় দেন।