এক্সক্লুসিভবাংলাদেশরাজধানী

ঢাকার পাঁচ তারকা হোটেলগুলোতে উন্মাতাল থার্টিফার্স্ট উদযাপিত

তরুণীর ব্রাউন চুল। পরনে শর্টস আবেদনময়ী পোশাক। পায়ে হাইহিল জুতা।  হাতে হুইস্কির গ্লাস। মুখে সিগারেট। মাঝে মধ্যে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন সঙ্গে সিগারেটে টান। বিটের তালে তালে উন্মাদ এই তরুণীকে বারবার জড়িয়ে ধরছেন এক তরুণ। বুকে চেপে ধরে একের পর এক চুমু। একটু পর পর হ্যাপি নিউ ইয়ার বলে উল্লাস করছেন।

তাদের মতো হাজারো তরুণ-তরুণী এভাবেই পাঁচ তারকা হোটেল লা-মেরিডিয়ানে ইংরেজি নতুন বর্ষ-২০২২ সালকে বরণ করে নিয়েছেন। লা-মেরিডিয়ানে এমন চিত্র হলেও পুরো ঢাকাবাসী নিজেদের মতো করে নানা আয়োজনে নতুন বছরকে বরণ করে নিয়েছেন।

থার্টিফার্স্ট নাইট উপলক্ষে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বেশকিছু নির্দেশনা আগেই দিয়েছিল। এরমধ্যে নতুন বছরকে বরণ করতে উন্মুক্ত স্থানে অনুষ্ঠান না করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। সন্ধ্যা ৬টার পর ঢাকা মহানগরীর কোনো বার খোলা রাখা যাবে না এবং রাত ১০টার পর সব ফাস্টফুডের দোকান বন্ধ থাকবে। এছাড়া আতশবাজি, গাড়ি-মোটরসাইকেল চালানোর ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকেই ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর দু’টি প্রবেশ পথ ছাড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল সবক’টি সড়ক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে যানবাহন চলাচলে ছিল নিষেধাজ্ঞা। বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। হাতিরঝিলসহ আরও কয়েকটি এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কও বন্ধ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বন্ধ করে দেয়ায় শহরের বিভিন্ন এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছিল। আধাঘণ্টার যাত্রাপথ যেতে দ্বিগুণ সময় লেগেছে। তবে সবকিছু ছাড়িয়ে থার্টিফার্স্ট নাইট উদ্‌যাপনের কোনো কমতি ছিল না। সন্ধ্যা থেকেই পটকা, আতশবাজি, ফানুস উড়ানোর মধ্য দিয়ে বরণ করা হয় নতুন বছরকে। যদিও ফানুস উড়াতে গিয়ে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

শুক্রবার রাত ১২টা পাঁচ তারকা হোটেল লা-মেরিডিয়ানের বলরুম। বিটের তালে তালে কাঁপছিল বলরুমের চার দেওয়াল, ফ্লোর। চারদিকে লেজার লাইটের ঝলকানি। মঞ্চে পারফর্ম করছিলেন ডিজে গার্ল ও বয়রা। ডিজে গার্লরা ছুড়ে দিচ্ছেন উড়ন্ত চুমু। আর হিন্দি-ইংরেজি গানের সঙ্গে মঞ্চের সামনে নাচছিলেন স্বল্পবসনা আবেদনময়ী তরুণীরা। তাদেরকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন মাতাল তরুণেরা। হুইস্কি-বিয়ার আর সিগারেটের ঘ্রাণের সঙ্গে মিশেছিল তরুণীদের অভিজাত প্রসাধনীর ঘ্রাণ। মাতাল তরুণ-তরুণী আর ডিজেরা পাচ্ছিলেন অন্যরকম এক অনুভূতি। নতুন বছরের কাউন্ট-ডাউনের সঙ্গে সবাই একসঙ্গে হ্যাপি নিউ ইয়ার বলে উদ্‌যাপন করেন থার্টিফার্স্ট নাইট। বাঁধভাঙা আনন্দে মেতে ওঠেন ইটস মাই লাইফ’ ‘সাকি সাকি রুম্বা’ ‘ওয়াকা ওয়াকা’- গানের তালে তালে।  

সরেজমিন দেখা যায়, শুক্রবার  রাত ৮টার পর থেকে লা-মেরিডিয়ানের নিচে ভিড় করতে থাকে শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত বিলাসবহুল গাড়ি। প্রতিটি গাড়িতেই দেখা যায় অভিজাত ঘরের সন্তানদের। তাদের সঙ্গে রয়েছেন বান্ধবীরা। হোটেলের নিরাপত্তাকর্মীদের চেকিং শেষে লিফ্‌টে উঠে অতিথিরা ১৪ তলা, ১৬ তলা ও ছাদে যাচ্ছেন। এই হোটেলটির অন্তত ৫টি স্থানে থার্টিফার্স্ট নাইট উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন করা হয়েছিল।

ঢাকার অন্তত দুই শতাধিক ডিজে তরুণী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে আগত অতিথিদের সঙ্গ দিয়েছেন। হোটেলটির ছাদে ছিল নানা আয়োজন। বলরুমের পাশাপাশি সুইমিং পুলের আশেপাশে ছিল নানা আয়োজন। বিক্রি হয়েছে  বিভিন্ন ব্যান্ডের বিদেশি মদ, বিয়ার, কোমল পানীয় ও খাবার। সেখানে টাকা দিয়ে টোকন সংগ্রহ করে খাবার নিতে হয়। গলাকাটা দামে বিক্রি হয় মদ, কোমলপানীয়সহ অন্যান্য খাবার আইটেম। ২০০ টাকার বিয়ার বিক্রি হয়েছে এক হাজার টাকায়। ৮ হাজার টাকা বোতলের মদ বিক্রি হয়েছে ১৫ হাজার টাকায়। ২৮০ টাকার বেনসন সিগারেট বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকায়। শুধু অ্যালকোহলের দাম নয়, খাবার আইটেমে রাখা হয় বাড়তি টাকা। হাফ লিটার পানি রাখা হয় একশ’ টাকা। ২০ টাকার কোকের দামও রাখা হয় একশ’ টাকা। এছাড়া অন্যান্য খাবারের দামও কয়েকগুণ বেশি রাখা হয়। 

বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যে ছিল জিরো আওয়ার, নিউ ইয়ার ইন ২০২২, ডিজে শান্ত, ডিজে প্রিন্স, ডিজে সনিকাসহ আরও অনেকের পারফর্ম। ফ্যাশন শো, ডিজে শো, ইটালিকো, ব্যান্ড লাইভ অনুষ্ঠান। প্রবেশ ফি ছিল ৪ হাজার টাকা থেকে শুরু। ছাদের অনুষ্ঠানের টিকেটে ভিন্নতা থাকায় সেখানে টিকেটের মূল্যও বাড়তি ছিল। পশ্চিমা ভঙ্গির পোশাকি তরুণীদের সঙ্গে আগত অতিথিরা নিজেদের মতো করে আনন্দ ভাগাভাগি করেছেন। অনেক অতিথির ভাষ্য, লা-মেরিডিয়ানে বিগত বছরগুলোর সব আয়োজনের চেয়ে এ বছরের আয়োজন ছিল সেরা। 

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বলরুমের দৃশ্য পাল্টায়। মদে-নাচে উন্মাদ তরুণ-তরুণীদের শরীরে ক্লান্তি আসে। বলরুমে চেয়ারে বসেন তরুণেরা। তাদের কোলে এসে বসেন তরুণীরা। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছিলেন। এতে করে তরুণীদের লিপস্টিক লাগে তরুণদের গালে-ঠোঁটে ও ব্লেজারে। প্রেমিকযুগল তরুণ- তরুণীদের পাশপাশি বলরুমে আগত মধ্যবয়সীদের মধ্যে আনন্দের কমতি ছিল না।  ব্ল্যাক ডেভিল বিয়ার ও অ্যাবসুলেট ভদকার গ্লাস হাতে নিয়ে তারাও নাচছিলেন। আর তাদেরকে বকশিসের বিনিময়ে সঙ্গ দিচ্ছিলেন ডিজে গার্লরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, মডেল, অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পী, সংবাদকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ডিজে পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন।

থার্টিফার্স্ট উপলক্ষে বারবিকিউ পার্টি, গান-বাজনার পাশাপাশি মদ-বিয়ারের ছড়াছড়ি ছিল ঘরে ঘরে। আগে থেকেই প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল বিশেষ এই দিনটি উদ্‌যাপনে। হোটেলে, বাসায় বাড়িতে, ছাদে ছিল নানা আয়োজন। থার্টিফার্স্ট উদ্‌যাপনকে ঘিরে হোটেলগুলো আগে থেকেই সাজানো হয়েছিল। বিভিন্ন ধরনের আয়োজন নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর ফেসবুক পেজে প্রচার-প্রচারণাও ছিল লক্ষণীয়। বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজের ব্যবস্থা করে আগে থেকে বুকিং ও টিকেটের ব্যবস্থা ছিল। হোটেলগুলোর বলরুম ও পার্টি প্লেস ভাড়া নিয়ে ইভেন্টম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এসব অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল।  আগে থেকেই বুকিং দেয়া ছিল দেশসেরা ডিজে গার্ল ও বার সিঙ্গারদের। কিছু কিছু হোটেলে মদের ছড়াছড়ির পাশাপাশি অনুষ্ঠানে ছিল ভিন্নতা।

লা-মেরিডিয়ানে ডিজে অলকা বলেন, আমি প্রতি বছর নিজে টিকেট কেটে থার্টিফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠানে আসি। এখানে এসে আগত অতিথিদের সঙ্গে নাচি। এতে করে কিছু টাকা বকশিস পাই। পুরো অনুষ্ঠানে ২০ থেকে ২৫ জনকে একটু একটু করে সময় দিলে ৩০ হাজার টাকার মতো আয় হয়।

ডিজে নুরিয়া বলেন, ডিজে পার্টিতে যাওয়া আমার পেশা। শুধু থার্টিফার্স্টের আয়োজন নয়। ঢাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি নাচি। পার্টিতে টাকার বিনিময়ে অভিজাত ঘরের ব্যক্তিদের সঙ্গ দেই। এতে করে যা আসে সেটাই আমার ইনকাম। ঢাকায় আমার মতো হাজারখানেক পেশাদার ডিজে আছে। এই হোটেলে থার্টিফার্স্ট উপলক্ষে অন্তত কয়েকশ’ ডিজে এসেছেন। আদনান রহমান নামের এক অতিথি বলেন, ৮ হাজার টাকায় দু’টি টিকেট কেটে এসেছি। সঙ্গে আমার গার্লফ্রেন্ড অর্না আছে। কোনো বছরই মিস করিনা দিনটি। কারণ বছরের এই দিনটি আমার কাছে স্পেশাল। এখানে ইজিলি মদ-বিয়ার খেতে পারি।

হুমায়ুন কবির নামের একজন বলেন, প্রাইভেট চাকরি করি। পুরো বছরই কাজে ব্যস্ত থাকি। শুক্রবার থাকায় এখানে এসেছি। টিকেট পেতে বেগ পেতে হয়েছে। এখানে খাবারের দাম অনেক চওড়া। কোনো খাবারই সাধ্যের মধ্যে না। মদের সরবরাহের সীমাবদ্ধতার কথা বলে কয়েকগুণ বেশি দাম নেয়া হচ্ছে। সোহেল আনান নামের আরেক অতিথি বলেন, ডিজেদের সঙ্গে নাচতে পছন্দ করি। ৫০০ বা ১০০০ টাকা করে দিলে পেশাদার ডিজেদের সঙ্গে নাচা যায়।

প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল থার্টিফার্স্টের আয়োজনের মধ্যে ছিল ক্যাফে বাজারে স্পেশাল ডিনার, স্পেশাল নাইট মিউজিক উইথ বারবিকিউ ডিনার। এছাড়া ডিজে লাইভ ব্যান্ড মিউজিক অনুষ্ঠান। ডিজে লাইফ ব্যান্ড মিউজিকে বুকিং ফি ছিল সিঙ্গেল ৫ হাজার টাকা সঙ্গে ড্রিঙ্ক। কাপল সাড়ে ৯ হাজার টাকা এবং সঙ্গে দু’টি ড্রিঙ্ক। সাড়ে ৪ হাজার টাকায় বারবিকিউ এবং বুফে ডিনার। ডিনার, বারবিকিউ চলে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। এছাড়া ডিজে লাইভ চলে রাত সাড়ে ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত। দু’জনের সিঙ্গেল রুম অফার ছিল ৮ হাজার ৫০০ টাকা।

ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের পৃথক তিন স্থানে থার্টিফার্স্ট নাইটের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বার, সেলিব্রেশন ও রুফটপে ফায়ারবক্স, মিউজিক্যাল নাইট ও ডিজে পার্টি ছিল। টিকেটের মূল্য ছিল ৫ হাজার টাকা। লা-মেরিডিয়ানের মতো এই হোটেলটিতে নতুন বছরকে বরণ করে নিতে রক সিঙ্গার মিলা ও কর্নিয়ার গানের তালে তালে বেসামাল হয়েছিল তরুণ-তরুণীরা। সন্ধ্যার পর থেকে হোটেলটিতে তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের অতিথিরা ভিড় জমানো শুরু করে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই হোটেলটিতেও দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে।

রেডিসন ব্লু ঢাকাতে ছিল  স্পেশাল ডিনারের ব্যবস্থা। এছাড়া একটি ইভেন্ট কোম্পানি বলরুম ভাড়া নিয়ে লাইভ ডিজে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বুফে ডিনারের ক্ষেত্রে জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ছিল ৪ হাজার ৯০০ টাকা। বারবিকিউ ডিনারের বুকিং ফি ৫ হাজার ৯শ’ টাকা। এছাড়া ডিনারের প্রবেশ ফি ৭ হাজার ৯শ’ টাকা। অনুষ্ঠান রাত ৯টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত চলে। এছাড়া পার্টির বাইরে বারের ব্যবস্থা ছিল। লবিতে ছিল বিশেষ আয়োজন।

কা ওয়েস্টিন হোটেলে থার্টিফার্স্ট উপলক্ষে  বলরুমে ছিল কাউন্টডাউন শো, ডিজে লাইভ অনুষ্ঠান।  সিঙ্গেলদের জন্য প্রবেশ ফি ছিল ৩ হাজার টাকা এবং কাপলদের প্রবেশ ফি ৬ হাজার টাকা। রাত সাড়ে ৯টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত এ অনুষ্ঠান চলে। ২৩ হাজার টাকার একটি ক্লাবরুম অফার ছিল যেটা বুকিং করলে ওয়েস্টিনের অনুষ্ঠানগুলো ফ্রি  দেখার সুযোগ।

Back to top button