বাংলাদেশিদের অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় কক্সবাজারের নির্জন পাহাড়ে। সেখানে হাত-পা ও চোখ বেঁধে চলে নির্মম নির্যাতন। এরপর টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। সময় মতো টাকা না দিলে পাহাড়ে গর্ত করে পুঁতে ফেলার নজিরও স্থাপন করেছে এ বাহিনী।
কক্সবাজারের স্থানীয়রা বলছেন, এসবের পেছেনে রয়েছে রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রিত সশস্ত্র বাহিনী হারাকা ‘আল-ইয়াকিন’।তারা বলছেন, বর্তমানে রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় বাংলাদেশিদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেছে এ বাহিনীর সদস্যরা। কক্সবাজারবাসী একে ‘জঙ্গি বাহিনী’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মোহাম্মদ ওমর ফারুককে (৩০) গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রথমে জানা যায়, স্থানীয় এক ডাকাত দল এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তবে কক্সবাজারের লোকজন বলছেন, ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল আল-ইয়াকিনের সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় দুই সদস্য পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
কক্সবাজারের স্থানীয়রা বলছেন, কক্সবাজার ও টেকনাফের প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন আল-ইয়াকিনের সদস্যরা। নিজ দেশ মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর হামলা। ওই হামলার সঙ্গেও জড়িত ছিল আল-ইয়াকিন। এখন তারা বাংলাদেশেও আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে মাদক বিক্রি, মানবপাচার, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, ডাকাতি ও মাদকের টাকায় আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের কথাও শোনা যায়।
২০১৯ সালে টেকনাফের বাহারছড়া টইগ্যা পাহাড়সহ বেশ কয়েকটি দুর্গম পাহাড়ে ড্রোন দিয়েও অভিযান চালায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। তবে তাদের অবস্থান শনাক্ত করা যায়নি।ইউটিউবে তাদের বেশ কয়েকজন নেতা নিয়মিত ভিডিও প্রচার করেন। এসব ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ডে (পারিপার্শ্বিক অবস্থা) নির্জন পাহাড় ও অস্ত্র দেখা যায়। তবে সেগুলো বাংলাদেশে ধারণকৃত কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
চলতি বছরের ১৯ মে টেকনাফ থেকে কামরুল হাসান নামের এক সিএনজিচালককে অপহৃত হন। তিনি বলেন, ‘আমাকে লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অপহরণ করা হয়। তারা আমার চোখ বেঁধে শালবন পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যায়। সেখানে দিনে দু-তিনবার মারধর করা হতো, পরনের কাপড় খুলে নির্মমভাবে পেটানো হতো।’
‘আমাকে দিয়ে বাবাকে প্রতিদিন ফোন দিত তারা। মুক্তিপণ হিসেবে ১০ লাখ টাকা দাবি করে। বাবাকে ফোন দিয়ে তারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে শব্দ শোনাত, যাতে তিনি ভয় পান। দ্রুত মুক্তিপণের টাকার ব্যবস্থা করেন। অপহরণের ১১ দিনের মাথায় পাঁচ লাখ টাকা দিলে তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। ক্যাম্পের কাছে আমার সামনেই তারা টাকাগুলো ভাগ করে নেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাহাড়ের চূড়ায় থাকাবস্থায় মাঝেমধ্যে আমার চোখ খুলে দেয়া হতো। সেসময় দেখতাম, তারা সংখ্যায় ১২-১৪ জন। সবার কাছে নাইন এমএম পিস্তল। পর্যাপ্ত গুলিও থাকত তাদের সঙ্গে। চার/পাঁচজনের কাছে দুটা করে অস্ত্র থাকত।’
ইউটিউবে প্রকাশিত এক ভিডিওতে আল-ইয়াকিনের নেতাদের দাবি, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার আরাকানের অংশ। তারা এতদিন মিয়ানমারের রাখাইনে ছিলেন। এখন তাদের আরেক রাজ্য কক্সবাজারে এসেছেন। তারা এখানেই থাকবেন।
কামরুল হাসান নামে ভুক্তভোগী এক সিএনজিচালক বলেন, আমাকে লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অপহরণ করা হয়। তারা আমার চোখ বেঁধে শালবন পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে যায়। সেখানে দিনে দু-তিনবার মারধর করা হতো, পরনের কাপড় খুলে নির্মমভাবে পেটানো হতো।বিভিন্ন ভিডিওতে রোহিঙ্গাদের দাবি আদায়ের কথা বললেও রোহিঙ্গারা বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত আল-ইয়াকিনের সন্ত্রাসীরা। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের লোকজন জানান, শালবন ও কুতুপালং ক্যাম্পে এ বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যের অবস্থান।
তবে আমরা শুনেছি, বর্তমানে রোহিঙ্গাদের প্রতিটি ক্যাম্পে আল-ইয়াকিনের সদস্যরা আছে। কুতুপালং ক্যাম্পের বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা হয়। পরিচয় গোপন করে তারা জানান, ক্যাম্পের অধিকাংশ মানুষই শান্তি চান। তারা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশনা অনুযায়ী চলাফেরা করেন। তবে আল-ইয়াকিনসহ বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন ক্যাম্পে অশান্তি সৃষ্টি করছে। শুধু বাংলাদেশি নয়, রোহিঙ্গারাও তাদের হাতে নির্যাতিত হচ্ছেন। চলতি বছরের মার্চে উখিয়ার বালুখালি ক্যাম্পে ভয়াবহ যে আগুনের ঘটনা ঘটে তা ছিল আল-ইয়াকিনের কাজ। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তারা রোহিঙ্গাদের ঘর পুড়িয়ে দেয়।
অপহরণ থেকে মুক্তি পাওয়া বেশ কয়েকজন বলেন, অপহরণের পরই চোখ-মুখ ও হাত বেঁধে নির্জন পাহাড়ে নেওয়া হতো। পাহাড়ে ওঠার পর তাদের পাও বেঁধে ফেলা হতো। সেখানে তিন-চার ফিট গভীর গর্তে রাখা হতো। মাথার ওপরে খোলা আকাশ। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি যা-ই হোক না কেন সেখানেই থাকতে হতো। পাশের ঝুপড়ি ঘরে অবস্থান করতেন অপহরণকারীরা।
তারা আরও বলেন, দিনে একবেলা তাদের খাবার দেওয়া হতো। অধিকাংশ সময় মিলত চিড়া-মুড়ি আর পানি। অন্যদিকে, সারাদিন চলত পাশবিক নির্যাতন। পুরোপুরি উলঙ্গ করে লাঠি দিয়ে পেটানো হতো। গলায় ছুরি ধরা হতো, মাঝেমধ্যে হাতে পোঁচ দিয়ে রক্ত বের করে দিত। ঘাড়ে ও মাথায় পিস্তল ঠেকাত, বাট দিয়ে আঘাতও করত। ভয় দেখাতে আকাশে ফাঁকা গুলি ছুড়ত। এ সময় তারা বলত, মুক্তিপণের টাকা না দিলে এখনই মেরে ফেলবে। বাঁচার জন্য ভুক্তভোগী যখন কান্না শুরু করত তখনই তারা পরিবারের কাছে ফোন দিত।
টেকনাফের উনচিপ্রাং এলাকার স্থানীয়রা জানান, ২০২০ সালের এপ্রিলে টেকনাফের জীমংখালি থেকে এক দিনমজুর ও দুই কৃষককে (জুমচাষি) তুলে নিয়ে যায় আল-ইয়াকিনের সশস্ত্র সদস্যরা। তারা তাদের পরিবারের কাছে মোট ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। ওই সময় তাদের উদ্ধারে টেকনাফের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস উনচিপ্রাং, মিনাবাজার, জীমংখালিসহ বেশ কয়েকটি পাহাড়ে অভিযান চালান। তবে তাদের উদ্ধার করা যায়নি। পরে তিন লাখ টাকা করে মুক্তিপণ দিয়ে দুজন কৃষক ফিরে আসেন। তবে দিনমজুরের পরিবার টাকা দিতে না পারায় তাকে হত্যা করা হয়। পরে তার মাটিচাপা মরদেহ মেলে জীমংখালির পাহাড়ে।
রোহিঙ্গারা জানান, ক্যাম্পে ত্রাস সৃষ্টি করা সশস্ত্র সংগঠন আল-ইয়াকিন সম্পর্কে মুখ খুলতে চান না কেউই। যদি তারা খুন করে ফেলে— এ ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস দেখান না। প্রতিনিয়ত তাদের হাতে ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন অসংখ্য রোহিঙ্গা নারী। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় ক্যাম্পের আশপাশের পল্লীচিকিৎসকের শরণাপন্ন হন তারা। অনেকে বাধ্য হয়ে গর্ভবতী হয়েছেন, অনেকে আবার গর্ভপাতও করিয়েছেন।
অসংখ্য নারীর অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাত করানো টেকনাফের এক পল্লীচিকিৎসক পরিচয় গোপন করে বলেন, অনেক আগে থেকেই আল-ইয়াকিনের নির্মম বর্বরতার কথা শুনেছিলাম। কখনও নিজ চোখে তাদের দেখিনি। তবে গত কয়েক মাসে তাদের হাতে ধর্ষণের শিকার পাঁচ/ছয় নারীর চিকিৎসা করেছি। তাদের সবার বক্তব্য হলো, আল-ইয়াকিনের সদস্যরা তাদের সর্বনাশ করেছে। ক্যাম্পের ভেতরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তেমন বিচরণ নেই। এ সুযোগে যা ইচ্ছা তা-ই করার সুযোগ পায় আল-ইয়াকিন। ইচ্ছা হলে তারা পরিবারের সদস্যদের সামনেই নারীদের ধর্ষণ করে। সর্বশেষ মে মাসে আল-ইয়াকিন সদস্যদের হাতে ধর্ষণের শিকার, পরে গর্ভবতী হওয়া এক রোহিঙ্গা নারী আমার কাছে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং গর্ভপাত করিয়েছেন।
কক্সবাজারের স্থানীয়রা (বাংলাদেশি) বলছেন, তারা কক্সবাজার ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অত্যাধুনিক অস্ত্র দেখেছেন। এগুলো অবৈধভাবে মিয়ানমার থেকে আনা। বিভিন্ন সময় পুলিশ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয় টেকনাফ ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে এসবিবিএল (একনলা বন্দুক), নাইন এমএম পিস্তল, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ওয়ান শুটারগান, এমনকি একে-৪৭ এর মতো আগ্নেয়াস্ত্রের সন্ধান পেয়েছে। মাঝেমধ্যে কিছু অস্ত্র ধরাও পড়ে।টেকনাফ থানা পুলিশ জানায়, তাদের সঙ্গে প্রায়ই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এছাড়া সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে প্রায়ই পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে এসব অস্ত্র উদ্ধার করে।