পুরান ঢাকার ফরিদাবাদের বাসিন্দা নূর মোহাম্মদ ও হোসনে আরা বেগম দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। দুজনই উচ্চ শিক্ষিত, পরিবার নিয়ে থাকেন বিদেশে। আর বয়োজ্যেষ্ঠ এই দম্পতি নিজেদের পুরোনো দুইতলা ভবনে থাকেন। গৃহকর্তা সেদিন সকালে গাজীপুরে যান। বাসায় থাকেন অসুস্থ হোসনে আরা বেগম। সন্ধ্যায় নূর মোহাম্মদ খবর পান, কে বা কারা তাঁর স্ত্রী হোসনে আরা বেগমকে খুন করে লাশ মেঝেতে ফেলে রেখেছে। রাতে বাসায় স্ত্রীর রক্তাক্ত লাশ দেখতে পান তিনি।
কারও সঙ্গে বিরোধ না থাকা নিরীহ হোসনে আরাকে কে বা কারা খুন করল, প্রথমে সে বিষয়ে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, ঘটনাস্থলের মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তের ওপর এক ব্যক্তির পায়ের ছাপ।
১৮ ডিসেম্বর এই হত্যাকাণ্ডের পর রাতেই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে শ্যামপুর থানায় মামলা করেন নূর মোহাম্মদ। এই হত্যা মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান শ্যামপুর থানার পরিদর্শক খন্দকার জালাল উদ্দিন মাহমুদ। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহ করেন। একই সঙ্গে ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজও জোগাড় করেন।
এরপর নানা সূত্র ধরে পুলিশ স্থানীয় কেব্ল নেটওয়ার্ক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের এক কর্মীকে সন্দেহভাজন হিসেবে শনাক্ত করে। প্রথমে স্বীকার না করলেও পরে খুনি স্বীকার করেন, হোসনে আরাকে তিনিই খুন করেছেন। খুনের কারণ, ৩০ বছর আগে হোসনে আরা তাঁকে থাপ্পড় মেরেছিলেন। ওই ব্যক্তির নাম লাভলু। ২১ ডিসেম্বর তিনি ঢাকার আদালতে হোসনে আরাকে খুনের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন। এখন তিনি কারাগারে।
আগে থেকে তাঁর ওপর রাগ ছিল লাভলুর। আর সেদিন বাসার কেব্ল লাইন ঠিক করার জন্য ফোন দেন হোসনে আরা। লাভলুকে সকালবেলা আসতে বলেছিলেন। তবে লাভলু সেদিন কাজ করতে আসেন বিকেলে। দেরিতে আসা নিয়েও বকাঝকা করেন হোসনে আরা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে লাভলু হোসনে আরাকে খুন করে পালিয়ে যান।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা খন্দকার জালাল উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘হোসনে আরা বেগম খুনের কাহিনি সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। আসামি লাভলু স্বীকার করেছেন, ৩০ বছর আগে হোসনে আরা বেগম তাঁকে থাপ্পড় মেরেছিলেন।তিনি আরও জানান, তাঁরা ঘটনাস্থলে গিয়ে একটি ইট জব্দ করেন। রক্তাক্ত হোসনে আরা মেঝেতে পড়ে ছিলেন। তাঁর মাথার কাছে ওই ইট এবং রক্তের মধ্যে একটি পায়ের ছাপ দেখা যায়।
লাভলুর বরাত দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা খন্দকার জালাল উদ্দিন বলেন, বেলা সাড়ে তিনটার পর লাভলু ওই বাসায় যান। তখন লাভলুকে নাশতা খেতে দেন হোসনে আরা। তবে দেরিতে আসা নিয়ে হোসনে আরা বকাঝকা করেন, তখন খেপে যান লাভলু। আর হোসনে আরার প্রতি আগে থেকে তাঁর ক্ষোভ ছিল। একপর্যায়ে হোসনে আরা যখন কাচের গ্লাসে করে পানি নিয়ে হাঁটছিলেন, তখন লাভলু ধাক্কা দিয়ে তাঁকে ফেলে দেন।
এরপর ঘরের বাইরে থেকে ইট নিয়ে প্রথমে হোসনে আরার মাথায় আঘাত করেন। তখন রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে যান তিনি। এরপরও মৃত্যু নিশ্চিত হয়নি দেখে লাভলু ভাঙা কাচের গ্লাস নিয়ে গলায় পোঁচ মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
এই হত্যাকাণ্ডের পর লাভলু এলাকা ছেড়ে যাননি। তিনি কেব্ল নেটওয়ার্কের কাজ করে যাচ্ছিলেন। হোসনে আরার মুঠোফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) পরীক্ষা করে সেখানে লাভলুর মুঠোফোন নম্বর পাওয়া যায়। এর সূত্র ধরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে তিনি হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন। তখন তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
তবে ঘটনাস্থলের মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা রক্তে পায়ের ছাপ আর লাভলুর পায়ের ছাপ মিলে যায়। তখন আবার তাঁকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন লাভলু হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে সব ঘটনা খুলে বলেন।
মামলায় হোসনে আরার স্বামী নূর মোহাম্মদ অভিযোগ করেন, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীকে খুন করে বাসার ১০ ভরি স্বর্ণালংকার ও আড়াই লাখ টাকা চুরি করেছেন।এ বিষয়ে পুলিশ কর্মকর্তা খন্দকার জালাল উদ্দিন বলেন, খুনের পর আলমারি খুলে লাভলু কিছু টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। পুরো বিষয়টি আরও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে, খুনের সঙ্গে আর কেউ জড়িত আছে কি না।