যেকোনো সম্পর্কের জন্য সবার প্রথমে প্রয়োজন আস্থা ও বিশ্বাস। কিন্তু চীন-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কের ৭০ বছর পূর্ণ হলেও কখনোই তা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখন যে সার্বিক পরিস্থিতি, তাতে অদূর ভবিষ্যতে তার কোনো সম্ভাবনাও দেখেন না পর্যবেক্ষকেরা। যদিও এশিয়ার এই দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক মোটের ওপর মন্দ নয়।
সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, প্রথমে এশিয়া এবং পরে গোটা বিশ্বে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নে সি চিন পিংয়ের চীন অনেক বেশি আগ্রাসী, দৃঢ়সংকল্প।ভারত ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের আলোচনায় গেলে সবার আগে আসবে সীমান্ত সমস্যা। ৩ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (এলএসি) সুনির্দিষ্ট চেহারা আজও দিতে পারেনি দেশ দুটি। এলএসি নিয়ে দুই দেশের চিন্তায় বিস্তর পার্থক্যও রয়েছে।
ভারতকে বলা হয় বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। এশিয়া মহাদেশের বিবেচনায় তাদের সামরিক বাহিনীও যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু চীনের সঙ্গে তুলনা করতে বসলে ছবিটা একটু অন্য রকম দেখায়। ১৯৯০ সালের কাছাকাছি সময়ে অর্থনীতির আয়তন এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে চীনের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিল ভারত।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে চীন যতটা এগিয়েছে, ভারত ততটা পারেনি। এখন চীনের অর্থনীতির আয়তন ভারতের পাঁচ গুণ, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে তাদের ব্যয় ভারতের চার গুণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ভারত মহাসাগরে নৌশক্তিতে অনেক এগিয়েছে, যা প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর তুলনায় বেইজিংয়ের অবস্থানকে সুসংহত করেছে।
১৯৬০–এর দশকের শুরুতে তিব্বত দখল করার পর ভারতের বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ ও ‘আকসাই চীন’কে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলে দাবি করে চীন। এভাবে যে সীমান্ত সমস্যার শুরু হয়, তা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সূচনা করে। ১৯৬২ সালের ওই যুদ্ধে চীন জয়ী হয়ে একতরফা যুদ্ধবিরতি জারি করে, আকসাই চীন দখলে রাখে কিন্তু অরুণাচল প্রদেশ ভারতকে ফিরিয়ে দেয়। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য ভারতকে সমর্থন দেয়। অন্যদিকে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে মৈত্রী বাড়াতে সচেষ্ট হয়।সীমান্তে উত্তেজনার পথ ধরেই ২০১৭ সালে ভুটানের ডোকলাম মালভূমিতে ভারত ও চীনা সেনার সংঘর্ষ হয়।
গালওয়ান উপত্যকার ঘটনায় চীনের মূলত উদ্বেগ ছিল ভারতের বাজার হারানোর শঙ্কা নিয়ে, অন্য কোনো বিষয়ে না। ভারত ওই সময় বেশ কিছু চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে। প্রসঙ্গত, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলি সংস্থা বিএসএনএল এবং এমটিএনএল বিপুল পরিমাণ চীনা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে। বিএসএনএলে দুই চীনা সংস্থা জেডটিই ও হুয়েইয়ের যন্ত্রাংশের অংশীদারি যথাক্রমে ৪৪ এবং ৯ শতাংশ। রিলায়েন্স, আইডিয়াসহ বিভিন্ন বেসরকারি মোবাইল পরিষেবা সংস্থাও চীনা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনা যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের দিকে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ অবস্থায় ভারতে ‘জাতীয়তাবাদের বিস্তার’ ও রাজনৈতিক সরকারের ‘শক্ত অবস্থানের’ প্রেক্ষাপটে চীনের তরফে বিকল্প বাজার খোঁজার বিষয়েও আলোচনা হয়েছিল।
২০২০ সালের ১৫ জুন ভারত-নিয়ন্ত্রিত পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারতের একটি সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতাহাতি যুদ্ধে ২০ ভারতীয় জওয়ান প্রাণ হারান। চীনের তরফে মাত্র একজন সেনার প্রাণহানির কথা কবুল করা হয়। শুধু গালওয়ান নয়, অচলাবস্থা তৈরি হয় লাদাখের গালওয়ান, প্যাংগং লেকের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্ত, গোগরা, ডেপস্যাং, হটস্প্রিং—মোট ছয়টি এলাকায়। পূর্ব লাদাখের গোটা ঘটনা ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর দুটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে তলানিতে নামিয়ে আনে। আর জোরালো হয়ে ওঠে ভারতে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ। ডাক ওঠে চীনা পণ্য বর্জনের। কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের উসকানি, বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কর্কশ চিৎকার পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে।
গত দেড় বছরে উভয় দেশের সেনারা কমান্ডার পর্যায়ে অন্তত ১২টি বৈঠক করেছেন। মধ্য জুলাইয়ে (২০২১) তাজিকিস্তানে সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে বৈঠক হয়েছে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও ওয়াং ইর মধ্যে। এতে ডেপস্যাং, হটস্প্রিং ছাড়া বাকি এলাকাগুলোতে উত্তেজনা হ্রাস পেয়েছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। সীমান্তে উভয় দেশই সৈন্য সরিয়ে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত সীমান্তে বিপুল পরিমাণ জমির দাবি পরিত্যাগ করেছে বলে আলোচনা আছে। অপর দিকে বাস্তবে সীমান্তে উত্তেজনা কমেনি মোটেও।
দুই দেশের সম্পর্কের এই অবস্থার মধ্যেই চীন নয়া স্থল সীমান্ত আইন করেছে, যা গত ২৩ অক্টোবর ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটি অনুমোদন দিয়েছে। সরকারি সংবাদ সংস্থা সিনহুয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, চীনের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্যে আগামী ১ জানুয়ারি (২০২২) থেকে ওই নতুন আইন কার্যকর হবে।
নয়া আইন অনুযায়ী, চীনের স্থল সীমান্তের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকর এমন কোনো পদক্ষেপের আঁচ পেলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতের পথে হাঁটবে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ)। পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পরিকাঠামো, সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ওই আইনে।
এই আইন নিয়ে আপত্তি জানিয়ে নয়াদিল্লি বলেছে, নয়া আইন প্রণয়নের বিষয়ে চীনের একতরফা সিদ্ধান্ত বর্তমান দ্বিপক্ষীয় সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, যা সীমান্তসংক্রান্ত বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কারণ।অপর দিকে জাতীয়তাবাদী আবেগ কেবল ভারত দেখাচ্ছে না। চীনও কম যায় না। লাদাখের ঘটনা চীন তার স্কুলে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করেছে। দেশকে রক্ষা করতে যেভাবে চীনা সেনা ও অফিসাররা সীমান্তে প্রতিনিয়ত লড়ে চলেছেন, তা স্কুলের ছেলেমেয়েদেরও পড়ানো হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম গড়ে ওঠে।
দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হয়, ভারতের চিন্তাজুড়ে যতটা চীন রয়েছে, চীনের চিন্তায় আবার ততটা ভারত নেই। তা না থাকলেও প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক-বাহক এই দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপরেই গোটা এশিয়ার ঐক্য নির্ভর করছে। আর সন্দেহাতীতভাবে এই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যুক্ত রয়েছে একাধিক ‘তৃতীয় পক্ষ’। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, চীনের সঙ্গে পাকিস্তান আর ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, এই ‘সম্পর্কের’ বিষয়টি মেনে নিয়েই দুই দেশকে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। দুই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের বিপুল প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে আসা মুক্ত আলোচনাই পারে অবিশ্বাস কমিয়ে পরস্পর আস্থা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি করতে।