দুর্দিনে রহিমআফরোজ গ্রুপ
১৯৪০-এর দশকে সীমিত পরিসরে ট্রেডিং ব্যবসায় যুক্ত হন এ সি আবদুর রহিম।১৯৪৭ সালে যৎসামান্য পুঁজি নিয়ে চট্টগ্রামে গিয়ে ব্যবসার পরিধি বড় করেন তিনি। এরপর ১৯৫৪ সালের ১৫ এপ্রিল রহিমআফরোজ অ্যান্ড কোং নামে একটি কোম্পানি গড়ে তোলেন তিনি। ১৯৫৯ সালে তিনি দেশে যুক্তরাজ্যের লুকাস ব্যাটারির বিপণন শুরু করেন। বিপণন করেছেন অস্ট্রেলিয়ার ডানলপ টায়ারেরও। লুকাস ব্যাটারি ও ডানলপ টায়ারের বিক্রিতে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করেন এ উদ্যোক্তা।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশে লুকাস ব্যাটারি অধিগ্রহণের মাধ্যমে ব্যবসায়ে বড় সাফল্য আসে রহিমআফরোজের। ১৯৮২ সালে আবদুর রহিম মারা গেলে তার তিন সন্তান আফরোজ রহিম, ফিরোজ রহিম ও নিয়াজ রহিম ব্যবসার হাল ধরেন। পিতার রেখে যাওয়া কোম্পানি দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে আরো বড় হয়ে রূপ নেয় দেশের শীর্ষস্থানীয় করপোরেটে।
একসময় উচ্চশিক্ষিত তরুণদের চাকরির জন্য রহিমআফরোজ ছিল লোভনীয় এক করপোরেট হাউজ।বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে শিল্প গ্রুপটিতে যোগদান ছিল সাধারণ ঘটনা। উৎপাদনের পাশাপাশি বহুজাতিক বিভিন্ন কোম্পানির ব্যাটারি বিপণনের মাধ্যমে দেশের ব্যাটারি বাজারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। আইপিএস ও ইউপিএসের বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আমদানীকৃত গাড়ির টায়ার, লুব্রিকেন্ট ও জ্বালানির বাজারেও দাপট ছিল গ্রুপটির। সোলার প্যানেল ও আগোরার মতো রিটেইল সুপারশপের মাধ্যমে গণমানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল রহিমআফরোজের নাম।
দেশে ব্যাটারি শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়েছিল রহিমআফরোজ।আইপিএস আর সোলার প্যানেলের মাধ্যমে অন্ধকারে আলো পৌঁছে দেয়ার কাজেও নেতৃত্বও দিয়েছে গ্রুপটি। ১৯৫৪ সালে এ সি আবদুর রহিমের হাত ধরে জন্ম রহিমআফরোজ অ্যান্ড কোংয়ের। প্রতিষ্ঠার পরবর্তী ৬০ বছরে উত্তরসূরিদের হাতে গ্রুপটির বিকাশ ও বিস্তৃতি হয়েছে ঈর্ষণীয় মাত্রায়। ব্যবসায়িক সততা ও কার্যকর সুশাসনের দিক থেকেও রহিমআফরোজের সুনাম ছিল গোটা করপোরেট জগতে। দীর্ঘকালীন অর্জিত সুনামের কারণে পর্যাপ্ত জামানত ছাড়াই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণও পেয়েছে শিল্প গ্রুপটি।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার ঋণ আছে রহিমআফরোজের।ব্যবসায়িক বিপর্যয়ে খেলাপি হয়েছে গ্রুপটির বেশির ভাগ ঋণ। পুনঃতফসিল করে ঋণ নিয়মিত করার উদ্যোগ নিয়েছে গ্রুপটি। তবে ডাউন পেমেন্ট দেয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ জমা দিতে না পারায় আটকে গেছে অনেক ঋণের পুনঃতফসিল প্রক্রিয়া। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, কর্মীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা পরিশোধ করাও এখন রহিমআফরোজের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখন ব্যাংকের তালিকায় খেলাপি হওয়ায় ঋণপত্রও খুলতে পারছে না শিল্প গ্রুপটি।স্থবিরতা নেমে এসেছে ব্যাটারি উৎপাদন, বিপণন ও রফতানিতে। কোম্পানি টিকিয়ে রাখতে রফতানির চিন্তা বাদ দিয়ে আপাতত ব্যাটারির স্থানীয় বাজার ধরে রাখাতেই মনোনিবেশ করেছে গ্রুপটি।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নিয়াজ রহিম বলেন, বহুজাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বনামধন্য কর্মীদের আমরা নিয়োগ দিয়েছিলাম। কাজ করার জন্য তাদের একটি আদর্শ পরিবেশও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দায়বদ্ধতা না থাকায় ফলপ্রসূ হয়নি। সুস্থ থাকা অবস্থায় কাজ শেষে অনেক রাতেও বাসায় ফিরতাম।কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে কাজ বুঝে নেয়া হয়নি। এ জবাবদিহিতার অভাবই রহিমআফরোজের আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
নিয়াজ রহিম ২০১৩ সালে অনেকটা আকস্মিকভাবে গুলেনবারি সিনড্রম (জিবিএস) রোগে আক্রান্ত হন।এরপর প্রায় তিন বছর তিনি দেশে ও সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। দীর্ঘ এ সময়ে ব্যবসা থেকে পুরোপুরি বাইরে ছিলেন তিনি। তার এ দীর্ঘ অনুপস্থিতি রহিমআফরোজ গ্রুপের ব্যবসায়িক বিপর্যয়ে প্রভাব ফেলেছে। মূলত ওই সময় থেকেই শিল্প গ্রুপটির কোম্পানিগুলোর মুনাফা কমতে শুরু করে।
নির্মম এ বাস্তবতার কথা মানছেন রহিমআফরোজের গ্রুপ পরিচালক নিয়াজ রহিমও।তিনি বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে গিয়ে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছি। আগোরা করতে গিয়ে কৃষিতেও বড় অংকের বিনিয়োগ করেছিলাম। সেখানেও লোকসান হয়েছে ৭০-৮০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা বাতাসে ভেসে গিয়েছে। এত বড় লোকসান কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে করতেই এল করোনার আঘাত। গত দুই বছরে বেশির ভাগ সময়ই কর্মীদের বসিয়ে রেখে বেতন দিতে হয়েছে। এ মুহূর্তে কর্মীদের বেতন-ভাতা যথাসময়ে পরিশোধ করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন খারাপ পরিস্থিতি রহিমআফরোজ গ্রুপের ৭০ বছরের ইতিহাসে আসেনি।
১৯৮৫ সালে দেশে প্রথমবারের মতো ব্যাটারি উৎপাদন শুরু করে রহিমআফরোজ।একই বছর ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ামের সহায়তায় শুরু হয় সোলার পাওয়ার বিপণন। ১৯৯২ সালে সিঙ্গাপুরে ব্যাটারি রফতানির মাধ্যমে রহিমআফরোজের নাম বিদেশেও বিস্তৃত হয়। এরপর ১৯৯৩ সালে প্রথম আইপিএস চালু করে কোম্পানিটি। ২০০০ সালে ভারতের আহমেদাবাদে অফিস খোলে রহিমআফরোজ। ২০০১ সালে আগোরা নামের সুপারস্টোর চালু করে গ্রুপটি।
বর্তমানে রহিমআফরোজ গ্রুপের অধীনে চালু আছে ১৫টির বেশি কোম্পানি।এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ আছে রহিমআফরোজ ব্যাটারির নামে। কোম্পানিটির নামে ব্যাংকঋণ আছে ৫২২ কোটি টাকা। রহিমআফরোজের দুটি কোম্পানির নামে প্রায় ৩১০ কোটি টাকার ঋণ আছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডের। অনেক আগেই খেলাপির খাতায় নাম উঠেছে পুরো ঋণ। তবে ঋণটি পুনঃতফসিলের উদ্যোগ নিয়েছে রহিমআফরোজ গ্রুপ। এর মধ্যে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে পুনঃতফসিলের প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠিয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক। যদিও ৩ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দেয়ার শর্ত দিয়ে পুনঃতফসিল প্রস্তাবটি ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আর্থিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে বর্তমানে স্থায়ী সম্পদ ও কিছু কোম্পানি বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে রহিমআফরোজ গ্রুপ। এরই মধ্যে সুপারশপ আগোরা বিক্রি করে দেয়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে গ্রুপটি।তবে আগোরার বিদেশী অংশীদারদের সঙ্গে কিছু বিষয়ে মতের অমিল হওয়ায় এখনো বিক্রির প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি রহিমআফরোজ। ব্যয় কমাতে গ্রুপটি এরই মধ্যে কর্মী সংখ্যা কমিয়ে এনেছে। রহিমআফরোজের কর্মীর সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার থেকে বর্তমানে এক হাজারে নেমে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
নিয়াজ রহিম বলেন, রহিমআফরোজ আমাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান।পরিবারের প্রত্যেক সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে তার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। উত্তরাধিকারীদের ঐক্য ধরে রাখতে আমাদের পারিবারিক সংবিধানও আছে। আমার তিন সন্তান বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে। রহিমআফরোজের এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট হলো ক্যাশ-ফ্লো সংকট।
আমরা সরকার ঘোষিত কোনো প্রণোদনার অর্থ এখনো পাইনি। আশা করছি, দ্বিতীয় দফায় আমরা প্রণোদনার অর্থ পাব। কোনো ব্যাংক বা ব্যক্তির কাছে আমরা দয়া চাই না। ব্যাংকগুলোর কাছে শুধু ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়ার আবেদন করছি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ সহায় থাকলে কোনো সংকটই থাকবে না।