বিশ্বের বৃহত্তম জোঁকের খামার রাশিয়াতে
পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ প্রজাতির জোঁক আছে। সাহারা অঞ্চলে উটের নাসারন্ধ্র, আফ্রিকান জলহস্তির মলদ্বার, সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং গুহা বাদুড়ের শরীর আশ্রয় করে বেঁচে থাকে অনেক জোঁক। এর মধ্যে একটিমাত্র প্রজাতি মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।
রক্ত চুইষ্যা খাইছে। অজম করতে দিমু না, যা থাকে কপালে।-জোঁক ছোটগল্পের ওসমানের এই মেটাফরিক সংলাপের মাধ্যমে সমাজের শোষক শ্রেণিকে জোঁকের সঙ্গে তুলনা করেছেন আবু ইসহাক। জোঁক মানেই এমন পিচ্ছিল, ঘা ঘিন ঘিন করা, রক্তচোষক এক ঘৃণিত প্রাণী। ভয় আর ঘৃণাই শুধু জোটে এই ক্ষুদ্র প্রাণীটির ভাগ্যে।কিন্তু আসলেই কি জোঁক মানুষের কোনো উপকারে আসে না? উপকারে না এলে তো রাশিয়াতে সোভিয়েত আমলের এতোবড় জোঁকের খামার আজও টিকে থাকতো না। সেই পথ অনুসরণ করছে ব্রিটেনও!
রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর শহরতলী উদেলনায়া ‘অরগানিক ফার্ম’। খামারের ভেতরে বড় বড় আলমারি। বইয়ের পরিবর্তে সেখানে কেসগুলোতে পানি ভরা কাচের বয়ামে কিলবিল করছে কয়েক ডজন জোঁক।মস্কোর বাইরে তিন-তলা ভবনটি স্ট্যালিন-যুগের। বিশ্বের বৃহত্তম জোঁকের খামার, যেখানে প্রতি বছর ৩০ লাখ পর্যন্ত এই ক্ষুদ্র রক্তচোষা প্রাণীর উৎপাদন করা হয়। এদের খাওয়ানো হয় গরুর রক্ত। প্রায় এক বছর লালনপালন করা হয়। এরপর তাদের একটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকে পাঠানো হয়। আবার একটি অংশ খামারের ল্যাবে মেরে ফেলে গুঁড়ো করে ক্রিম, শ্যাম্পু এবং লোশনের উপাদান তৈরি করা হয়। এ ধরনের প্রসাধনী পণ্যের দাম হয় ১ হাজার ডলার পর্যন্ত।
সহস্রাব্দ ধরে জোঁক একটি বিতর্কিত চিকিৎসা সরঞ্জাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই ক্ষুদ্র পিচ্ছিল প্রাণীটির চেহারা এবং নিরাময় ক্ষমতা একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে ভীতি থেকে বিকর্ষণ এবং মুগ্ধতা তৈরি করে এসেছে।২০০৪ সালে চিকিৎসায় জোঁকের ব্যবহার অনুমোদন দেয় যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন। এটির জন্য ‘মেডিকেল ডিভাইস’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করে তারা। এর মাধ্যমে প্রায় একশ বছরের বিস্মরণের পর পশ্চিমা চিকিৎসা ব্যবস্থার মূলধারায় প্রত্যাবর্তন করে জোঁক।
এই জোঁক হিরুডো মেডিসিনালিস বা ঔষধি জোঁক নামে পরিচিত। স্বাদু পানির পরজীবী এটি। বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীদের রক্ত পান করে বেঁচে থাকে এরা। এদের আছে ১০টি চোখ এবং পাকস্থলী, ছয়টি হৃৎপিণ্ড এবং তিনটি চোয়াল। চোয়ালে আছে ৯০টি ধারাল দাঁত। এই দাঁত দিয়েই সেকেন্ডের মধ্যে মানুষের ত্বক বিদীর্ণ করে রক্ত চুষে খায়।
জোঁকের কামড় হলো প্রোটিন এবং এনজাইম সমৃদ্ধ ওষুধের ভাণ্ডার। এই উপাদানগুলো রক্ত সঞ্চালনকে উদ্দীপিত করতে পারে। এছাড়া বিপাক ক্রিয়া ও রক্ত কোষ তৈরি ত্বরান্বিত করতে পারে, কোলেস্টেরল কমাতে পারে এবং হৃদরোগ, গ্লুকোমা, ডায়াবেটিস এবং বন্ধ্যাত্বে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উপকারে আসে।
জোঁকের খামারটি ১৯৩৭ সাল থেকে একই স্থানে রয়েছে। প্রাথমিকভাবে বনজঙ্গল থেকে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য এটিকে ব্যবহার করা হতো। এখানে এখনো প্রকৃতি থেকে জোঁক সংগ্রহ করা হয়। মূলত অন্তঃপ্রজনন (ইনব্রিডিং) রোধ করতেই এটি করা হয়। কারণ অন্তঃপ্রজননের ফলে উৎপাদিত প্রজন্ম কম সক্রিয় এবং কম কার্যকর হয়।খামারটি থেকে স্ট্যালিনের সময় থেকেই ক্রেমলিনে বিভিন্ন লোকের কাছে চাহিদা মতো জোঁক পাঠানো হয়। অবশ্য প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ব্যক্তিগত থেরাপিতে জোঁক ব্যবহার করেন কি-না সেটি স্পষ্ট নয়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে কমিউনিস্ট-পরবর্তী বছরগুলোতে খামারটি টিকিয়ে রাখা বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিল। কারণ ওই সময় মানুষ এলোপ্যাথিক ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, ফলে জোঁকের অর্ডার বন্ধ হয়ে যায়।
তবে আবার চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে জোঁক থেরাপি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অনেক বেসরকারি ক্লিনিকে জোঁকের থেরাপি দেওয়া হয়। অবশ্য বৃহৎ এবং মূলধারার ক্লিনিকগুলোতে এ ধরনের বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো সেভাবে ব্যবহার করা হয় না।
জোঁকের প্রজনন ও প্রতিপালন সম্পর্কে খামারের কর্মীরা জানান, এখানে তাঁদের প্রধান কাজ হলো এগুলোকে খাওয়ানো। এরা তিন থেকে চার সপ্তাহে মাত্র একবার খায়। শরীরের ওজনের পাঁচগুণ খায় তারা। তাদের খাদ্য হলো গবাদি পশুর রক্ত। মস্কোর কাছের কসাইখানাগুলো এই রক্ত সরবরাহ করে।খামারটিতে সপ্তাহে প্রায় ৩০০ গ্যালন রক্ত লাগে। অর্থাৎ ১০০ টিরও বেশি গরুর রক্ত আসে এই খামারে। রক্ত হতে হয় অবশ্যই তাজা। গরু জবাই করার পরপরই উষ্ণ রক্ত আনা হয় এখানে।