মার্কিন প্রেসিডেন্টদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী নিউক্লিয়ার ফুটবল
একটা জনপ্রিয় ধারণা আছে প্রেসিডেন্টের কাছে একটা লাল বোতাম আছে, যেটাতে টিপ দিলেই আমেরিকার শত্রু দেশের ওপর পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হবে। বাস্তবে বিষয়টা এত সরল নয়। প্রেসিডেন্টদের এই ফুটবলের বেশিরভাগ তথ্যই অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে রক্ষা করা হয়। তাই সব তথ্য সাধারণ মানুষদের জানার সুযোগ নেই। তবে গত কয়েক দশকের সময়ের ব্যবধানে অনেক তথ্যই জানা সম্ভব হয়েছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় আশঙ্কা ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার ওপর অতর্কিতভাবে পারমাণবিক হামলা করতে পারে। এতে আমেরিকার পারমাণবিক সক্ষমতা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ফলে তাৎক্ষণিক প্রতি-আক্রমণমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্দেশ্যে আমেরিকার ৩৪ তম প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ারের প্রশাসন এই নিউক্লিয়ার ফুটবলের ধারণা নিয়ে আসে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টরা হোয়াইট হাউজের বাইরে আসলে তাদের পেছনে দেখা যাবে এক সামরিক কর্মকর্তাকে, যিনি একটি ‘ব্রিফকেস’ নিয়ে হাঁটছেন। সাধারণত এটা কালো রঙের হয়ে থাকে। এই ব্রিফকেসই ‘নিউক্লিয়ার ফুটবল’। ব্রিফকেসটি সব সময় বন্ধ করা থাকে। প্রেসিডেন্টরা কোনো পারমাণবিক বোমা হামলার প্রয়োজন মনে হলেই কেবল ব্যাগটি খুলতে পারেন।
তাহলে এই ব্যাগে কি কোনো ফুটবল আছে? ‘নিউক্লিয়ার’ শব্দটি দেখে মনে হতে পারে ব্যাগে ফুটবল আকৃতির কোনো পারমাণবিক বোমা রাখা আছে। বাস্তবে প্রেসিডেন্টরা এরকম পারমাণবিক বোমা সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ান না। তবে এর মাধ্যমে তারা পারমাণবিক বোমা হামলার নির্দেশ দিতে পারেন। বর্তমানে ভাইস প্রেসিডেন্টরাও বিকল্প নিউক্লিয়ার ফুটবল সাথে রাখেন। কিন্তু আক্রমণের নির্দেশ কেবল প্রেসিডেন্ট একাই দিতে পারেন। তাই তিনি হোয়াইট হাউজ থেকে বের হলেও সার্বক্ষণিক তার সঙ্গী হয়ে থাকে এটা।
এই ফুটবলটি তৈরি করেন ক্যাপ্টেন অ্যাডওয়ার্ড বিচ জুনিয়র, যিনি ছিলেন একজন সাবমেরিন অফিসার। তিনি প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের নেভাল এইড হিসেবেও কাজ করেন। আইজেনহাওয়ারের পর থেকে পরবর্তী সকল প্রেসিডেন্টদের কাছে এই ব্যাগটি শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রথমবার করা হয় জন এফ কেনেডির কাছে। প্রথমবারের মতো এই ব্যাগের ছবিও দেখা যায় প্রেসিডেন্ট কেনেডির সময়েই। ১৯৬৩ সালের ১০ মে তিনি কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য ম্যাসাচুসেটসের হাইয়ানিস পোর্টে গেলে এই ফুটবলকেও সাথে দেখা যায়।
এর নাম ‘ফুটবল’ কবে থেকে হলো, তার সঠিক উৎস জানা যায় না। তবে ১৯৬৫ সালে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের রিপোর্টার বব হরটনের এক আর্টিকেলে এই শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। লেখাটি ছিল এর ২ বছর আগে কেনেডির মৃত্যু ও প্রেসিডেন্টের পারমাণবিক ক্ষমতার হস্তান্তর বিষয়ে। হরটন লেখেন, কেনেডি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর টেক্সাসের ডালাসে হাসপাতালে মৃত্যুপথযাত্রায় ছিলেন।
২০০৫ সালে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের আরেক আর্টিকেলে দাবি করা হয়, আমেরিকার প্রথম পারমাণবিক যুদ্ধের পরিকল্পনা বা এসআইওপির সাংকেতিক নাম ছিল ‘ড্রপকিক’। এখান থেকেই ফুটবল কথাটা এসেছে। তবে এ রকম কোনো সাংকেতিক নাম আদৌ ছিল কিনা তা নিয়েও আছে বিতর্ক। যেখান থেকেই নামটি এসে থাকুক, আমেরিকানরা একে ফুটবল বলেই ডাকে। এমনকি প্রেসিডেন্ট ও যে সামরিক কর্মকর্তা এটা বহন করেন, তারাও এই নামই ব্যবহার করে থাকেন।
এই ব্রিফকেসকে দাপ্তরিকভাবে বলা হয় ‘প্রেসিডেন্টের জরুরি থলে’। তবে এটা নিউক্লিয়ার ফুটবল বা শুধু ফুটবল নামেই বেশি জনপ্রিয়। প্রেসিডেন্টরা শপথ নেওয়ার পর থেকেই পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টদের কাছ থেকে এই ফুটবলটি গ্রহণ করে নেন।
এটি থাকার কারণ দুটি। এটা দিয়ে পারমাণবিক বোমা হামলার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্বের বস্তুগত নিদর্শন বোঝানো যায়। আরেকটি কারণ হচ্ছে, আমেরিকার বিরুদ্ধে হঠাৎ কোনো দেশ পারমাণবিক হামলার পরিকল্পনা করে থাকলে ওই মুহূর্তে দ্রুত পাল্টা আক্রমণ করার মতো ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রেসিডেন্টের যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকে, তাহলে কাজটা সহজ হয়।
৪৫ পাউন্ড ওজনের নিউক্লিয়ার ফুটবলে চারটি জিনিস থাকে। প্রথমটি হচ্ছে ব্ল্যাক বুক। এতে থাকে প্রতি আক্রমণ করার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে তথ্য। আরেকটি বইয়ে থাকে বিভিন্ন গোপন স্থানের নাম। একটা ফাইলে আট থেকে দশ পৃষ্ঠার বর্ণনা থাকে, জরুরি সম্প্রচার ব্যবস্থার প্রক্রিয়া নিয়ে। আরেকটা কার্ডে গোপন সঙ্কেত লেখা থাকে। ধারণা করা হয়, ব্রিফকেসে উন্নত প্রযুক্তির যোগাযোগ মাধ্যমও থাকে। কারণ ফুটবলের কিছু ছবিতে অ্যান্টেনাও দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে।
ব্ল্যাক বুকে থাকে আমেরিকার পারমাণবিক যুদ্ধের পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য। এর পূর্ব নাম ছিল SIOP (Single Integrated Operational Plan)। এতে পূর্ব অনুমোদিত আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিকল্প উপায় দেওয়া থাকে, যা জরুরি মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট গ্রহণ করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের প্রশাসনের সময় নিউক্লিয়ার যুদ্ধের পরিকল্পনা কিছুটা সরলীকরণ করে সারাংশ আকারে লিখা হয়। এটা অনেকটা রেস্তোরাঁর খাবারের মেন্যুর মতো করে লিখা থাকে।
যে কার্ডে গোপন সঙ্কেত লেখা থাকে, সেটাকে ‘বিস্কুট’ বলে ডাকা হয়। পারমাণবিক আক্রমণের ক্ষেত্রে এই বিস্কুটের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট যদি পারমাণবিক আক্রমণ জরুরি মনে করেন, তাহলে সবার আগে তাকে ‘ফুটবল’টা খুলতে হবে। তারপর সম্ভাব্য আক্রমণের কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। তিনি চাইলে সামরিক নেতাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারেন, তবে সেটি বাধ্যতামূলক নয়। ‘বিস্কুট’ এর মাধ্যমে তিনি পেন্টাগনে ন্যাশনাল মিলিটারি কমান্ড সেন্টারের এক সামরিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করবেন। সামরিক কর্মকর্তা যখন নিশ্চিত হবেন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকেই নির্দেশ পেয়েছেন, তখন তিনি আক্রমণের নির্দেশ দিবেন।
এর কয়েক মিনিটের মধ্যে আকাশ পথে স্ট্রাটেজিক বোম্বার থেকে কিংবা সাবমেরিন বা স্থলপথে মিসাইল আক্রমণ শুরু হবে। ‘বিস্কুট’ একসময় ফুটবলের ভেতরে রাখা হলেও প্রেসিডেন্টরা বর্তমানে এটা নিজেদের পকেটেই রেখে থাকেন। তবে এতে একাধিকবার উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে।