বেসরকারিভাবে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল
চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার মানুষ ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে মারা গেছে ৯৫ জন।বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে এ মুহূর্তে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। ফলে তাদের চিকিৎসা করতে হিমশিম খাচ্ছে পরিবারগুলো। একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় ব্যয় হচ্ছে গড়ে ৩৩ হাজার ৮১৭ টাকা। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোয় এ চিকিৎসায় খরচ করতে হয় ২২ হাজার ৩৭৯ টাকা আর বেসরকারি হাসাপাতালে রোগীপ্রতি গড় খরচ ৪৭ হাজার ২৩০ টাকা।
গবেষণায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) থেকে মোট ১ হাজার ১৭৬টি খানা জরিপ করা হয়। এর মধ্যে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা নিয়েছে এমন রোগী ছিল ৩০২ জন।যাদের ১৬৩ জন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে ও ১৩৯ জন নিয়েছে বেসরকারি হাসপাতালে।
ডেঙ্গু রোগীর স্বাস্থ্য ব্যয়ের এসব তথ্য নিয়ে এপিডেমিওলজিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক বার্ডেন অব ডেঙ্গু ইন ঢাকা, বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণাটির ফলাফল গতকাল প্রকাশ করা হয়।বিআইডিএসের রিসার্চ ফেলো ড. আবদুর রাজ্জাক সরকার গবেষণাটি পরিচালনা করেন।
চিকিৎসকের ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ, ওষুধের খরচ, যাতায়াত খরচ, হাসপাতাল বিল ইত্যাদির সম্মিলিত ব্যয়কে একজন রোগীর মোট খরচ হিসেবে দেখানো হয়েছে। দেখা গেছে, এক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালের রোগীপ্রতি ৬ হাজার ৭৬ টাকা খরচ হয়। দরিদ্র পরিবারগুলোকে তাদের খানার মোট আয়ের ১৩৯ শতাংশ পর্যন্ত ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যয় করতে হচ্ছে, যা আসছে তাদের পারিবারিক সঞ্চয়, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে নেয়া ঋণের মাধ্যমে। এমনকি সম্পদ বিক্রি করেও চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে হচ্ছে।
অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে অবস্থানের দিনের ওপর নির্ভর করে খরচ বাড়ে।একদিনের কম থাকলে রোগীপ্রতি খরচ হচ্ছে প্রায় ২৪ হাজার টাকা। চার-পাঁচদিনে ৩৬ হাজার টাকা, ছয়-সাতদিনে ৪৮ হাজার টাকা ও ৮-১০দিন থাকলে খরচ হয় প্রায় ৬১ হাজার টাকা। তবে ১০ দিনের বেশি থাকলে গড়ে ১ লাখ ২২ হাজার টাকার বেশি খরচ করতে হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে গড়ে রোগীপ্রতি অর্ধলাখ টাকার বেশি খরচকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মূলত ডেঙ্গু নির্ণয়ের পরীক্ষার নাম অ্যান্টিজেন টেস্ট, যা তিনদিনের মধ্যে করতে হয়।এর একটি কিটের দাম ১৫০ টাকার মধ্যে। সিবিসি বা রক্তের প্লাটিলেট কাউন্টের পরীক্ষার জন্য ১০০ টাকার বেশি লাগে না। আর অ্যান্টিবডি টেস্ট করতে হয় ছয়দিন পর। এ টেস্টের কিটও ১৫০ টাকার মধ্যেই থাকে। আবার এ জ্বরের চিকিৎসায় হাসপাতালে সর্বোচ্চ পাঁচদিনের বেশি থাকতে হয় না। বেসরকারি হাসপাতালে কেবিনে সব মিলিয়ে ২০-২৫ হাজার টাকার বেশি চিকিৎসা খরচ হওয়া উচিত না। সরকারি হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় চিকিৎসা ফ্রি। ফলে সরকারি হাসপাতালগুলোয় ৫-৭ হাজার ও কেবিনে থাকলে পাঁচদিনে সর্বোচ্চ ৮-১০ হাজার টাকা লাগতে পারে। কেননা এ রোগের চিকিৎসায় তেমন বাড়তি কোনো ওষুধ লাগে না। ফলে বাড়তি দাম রাখাটা রোগীর প্রতি এক ধরনের অন্যায় বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
হাসপাতালগুলো তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ফি নেয় উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, সব হাসপাতালে রোগীদের খরচ এক নয়।অনেক হাসপাতাল ইচ্ছামতো ফি নেয়। সরকার পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দিলেও বেশির ভাগ বিষয়ই অনির্ধারিত। এর সুযোগ হাসপাতালগুলো নেয়। তবে কোনো রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলে তার চিকিৎসার ব্যয়ও বেড়ে যায়। হাসপাতালগুলো একটু মানবিক হলে রোগীর জন্য খরচ বহন করা সুবিধাজনক হবে।
এর আগে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু পরীক্ষা ফি ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় হাসপাতালগুলোয় সেই নির্দেশনা না মানার অভিযোগ রয়েছে। এসব হাসপাতাল দ্বিগুণের বেশি অর্থ আদায়ের কারণে বিভিন্ন সময়ে জরিমানা করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। পরে গত ২৮ জুলাই বেসরকারি হাসপাতালগুলোর জন্য ডেঙ্গুর তিন ধরনের পরীক্ষার দাম বেঁধে দেয়া হয়। নির্দেশ অনুযায়ী, অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি ৫০০ টাকা, সিবিসি পরীক্ষার জন্য দিতে হবে ৪০০ টাকা।
বিআইডিএসের গবেষণায় বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকি ও এর আর্থিক ব্যয়ভার বেশ উদ্বেগজনক। এজন্য দুটি সুপারিশ গুরুত্বসহকারে করা হয়েছে।সেখানে বলা হয়, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে ও খানা পর্যায়ে এর আর্থিক বোঝা লাঘব করতে এ মুহূর্তে একটি কার্যকর জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ কৌশল বাস্তবায়ন করা জরুরি। সেই সঙ্গে এডিস মশাকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার জন্য বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম জোরদার করা উচিত। ডেঙ্গু সংক্রমণের বিরুদ্ধে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয় মোকাবেলা করার জন্য ঢাকা মহানগরীতে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচিসহ বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করা যেতে পারে।