ঊর্ধ্বমুখী ব্যয়ে চাপ বাড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের

এমনিতেই নিত্যপণ্যের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় জনজীবনে মারাত্মক চাপ পড়বে বলে মনে করছেন দেশের জ্বালানি ও বাজার বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন,  ১২ থেকে ১৩শ’ কোটি টাকা রয়েছে বিপিসি’র কাছে। ওই টাকা থেকে সরকার খরচ করতে পারতো। তা না করে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তেলের দাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির মধ্যে গতকাল ৪ঠা নভেম্বর থেকেই কার্যকর হয় বাড়তি ডিজেল ও কেরোসিনের নতুন দাম। এক লাফে লিটার প্রতি বেড়েছে ১৫ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতে করে পরিবহন ও কৃষি ব্যয় বাড়বে।

করোনার পর প্রায় সব পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে তিনগুণের বেশি। এর সঙ্গে স্থানীয়ভাবে বেড়েছে ডলারের দাম। এসব কারণে বাজার পরিস্থিতি উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এর প্রভাবে স্থানীয় পর্যায়ে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম গড়ে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে বুধবার রাত থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানো হয়েছে। এদিকে বৃহস্পতিবার বাড়ানো হয়েছে এলপিজির দাম। এতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ২৫৯ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩১৩ টাকা।

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যেমন থমকে গিয়েছিল, একইভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আয়ের ওপরও এর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকের ব্যবসাও বন্ধ হয়েছে। ফলে আয় কমে এসেছে দেশের একটি বড় অংশের মানুষের। এর বিরূপ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টার মধ্যেই জ্বালানি তেলের এই দামের প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে।

দেশে মোট জ্বালানির মধ্যে ডিজেলই ব্যবহার হয় ৭৩ শতাংশ। সেই ডিজেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে পণ্য উৎপাদন, পরিবহণ এবং গণপরিবহণ ব্যয় বাড়বে। একই কারণে আমদানি করা জিনিসপত্রের দামও বাড়বে। এছাড়া কৃষিতে সেচ, সার, বেসরকারি খাতে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচও বৃদ্ধি পাবে। কমবে টাকার মান, বাড়বে মূল্যস্ফীতির হার। যার প্রভাবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত চাপের মুখে পড়বে। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কেমিক্যাল বিভাগের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন, সরকার গত এক বছরে তেল বিক্রি করে অনেক লাভ করেছে। সেই টাকা গেল কোথায়? যেই টাকা লাভ করেছে সেই টাকা ভর্তুকি দিতে পারতো। সরকারকে বিষয়টি স্বচ্ছভাবে করা দরকার ছিল। তেলের দাম বিশ্ববাজারে বাড়লে ৬ মাস পরে তেলের দাম সরকার বাড়াতে পারে। কিন্তু বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে সম্প্রতি। অল্প ক’দিন হলো। হঠাৎ করে এত বেশি টাকা বাড়ানো উচিত হয়নি।

অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, সেবা খাতের খরচ বাড়লে মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ে। এর মধ্যে গণপরিবহণের ভাড়া বাড়লে মূল্যস্ফীতিতে চাপ বেশি পড়বে। জ্বালানি তেলের সঙ্গে প্রায় সবকিছু সম্পর্কিত। বিদ্যুৎ উৎপাদনেও এখন জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে বিদ্যুতের দামে এর প্রভাব পড়বে। সরকার দাম না বাড়ালে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। দেশে মোট জ্বালানির মধ্যে ডিজেল ব্যবহৃত হয় ৭৩ শতাংশ। বাকি ২৭ শতাংশ অন্যান্য জ্বালানি। ফলে ডিজেলের দাম বাড়ায় সব খাতেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সব মিলে বেশি ভোগান্তিতে পড়বেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত।

কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, যখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম কম ছিল তখন দেশে বেশি দামে তেল বিক্রি করেছে।জ্বালানি এমন একটা পণ্য যার দাম বৃদ্ধি মূলত সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলে। সার্বিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে যাবে। আজকের ডিজেলের দাম বেড়ে গেল কালকেই পরিবহণের ভাড়া বাড়বে। ফলে পরিবহণে যেসব পণ্য আসবে সেগুলোর দামও বাড়বে। পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। করোনাকালে এমনিতেই মানুষের আয় হ্রাস পেয়েছে। ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের টিকে থাকাটাই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। সেখানে এভাবে তেলের মূল্যবৃদ্ধি করে প্রান্তিক পর্যায়ের সাধারণ মানুষের সুরক্ষার জায়গাটা দুর্বল এবং আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং করা হয়েছে।

এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। সেই সময় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৩ টাকা কমিয়ে ৬৮ টাকা থেকে ৬৫ টাকা করা হয়। তার আগে ২০১৩ সালে প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ছিল ৬৮ টাকা। এর আগে ২০১২ সালে ছিল ৬৩ টাকা। ২০১১ সালে ৪ দফা দাম বাড়ানো হয়। তখন এই দুই পণ্যের দাম ছিল ৬১ টাকা।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গণমাধ্যমকে জানান, ভারতে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তেল পাচার হবে এ আশঙ্কায় দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে কেরোসিনের চাহিদা তেমন নেই। যেহেতু ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে সেজন্য কেরোসিনের দাম না বাড়ালে এটি মিশিয়ে ভেজাল করা হবে। সেজন্য কোরোসিনর দাম বাড়ানো হয়েছে।

Back to top button