ভাংচুর ও লুটপাটের পর খোলা হয় সিসিটিভির হার্ডডিস্ক
মন্দিরের দোতলায় উঠতেই হাতের বাঁ পাশে তুলসীগাছ। গাছটি ওপড়ানো। দানবাক্সটিও ভাঙা।নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীর রাধামাধব জীউর মন্দিরের সর্বত্র এ রকম তাণ্ডবের চিহ্ন।মন্দিরের ম্যানেজার অনন্ত কুমার ভৌমিক জানান, দানবাক্সে টাকা দিয়ে তুলসীগাছে প্রণাম করে ভক্তরা মন্দিরে ঢোকেন। গাছটি কেন মেরে ফেলা হলো? গাছ কী ক্ষতি করেছে। তিনি অভিযোগ করেন, গত শুক্রবার দুপুরে মন্দিরে পাথর মারা হয়েছে। এর আগে গত ২২ অক্টোবর মন্দির লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। হামলাকারীরা এখনো সক্রিয়।
নোয়াখালী জেলার হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সদস্যসচিব আইনজীবী পাপ্পু সাহা বাংলা ম্যাগাজিনকে জানান, লুটপাট ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য এই হামলা চালানো হয়েছে। হামলার সময় প্রত্যেকটি মন্দিরে লুটপাট করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় প্রশাসনের সব স্তরে সাহায্যের জন্য আমরা যোগাযোগ করেছি। কিন্তু সাহায্য পাইনি। স্থানীয় নেতারাও সমন্বিতভাবে এগিয়ে আসেননি।’
বেগমগঞ্জ উপজেলা পূজা উদ্যাপন কমিটির কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, চৌমুহনীতে সাতটি স্থায়ী মন্দির ও ছয়টি অস্থায়ী মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। এতে ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকার ক্ষতি ও লুটপাট করা হয়েছে। ১২টি দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাটে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৮১ লাখ টাকা। হামলায় ইসকন মন্দিরের প্রান্ত চন্দ্র দাস ও দুর্গামন্দিরে যতন সাহা নিহত হন। আহত হয়েছেন অন্তত ১০১ জন।
ইসকন মন্দিরের সামনের পুকুরে ১৬ অক্টোবর সকালে প্রান্ত চন্দ্র দাসের লাশ পাওয়া যায়। মন্দিরের ভক্ত কৃপালু শংকর দাস বলেন, প্রান্ত চন্দ্র মন্দিরের বাইরে পুকুরের সামনে ছিলেন। সেখানে তাঁকে পিটিয়ে হত্যার পর লাশ পুকুরে ফেলে দেয় হামলাকারীরা। তবে প্রান্তকে মারধরের ঘটনা তিনি দেখেননি, শুনেছেন।
ইসকন মন্দিরের সভাপতি রসপ্রিয় দাস জানান, ঘটনার পর থেকে মন্দিরে তাঁরা পুলিশ পাহারায় আছেন। ঘটনার দিন তো পুলিশ-বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার লোক ছিল। কিন্তু হামলা থেকে বাঁচাতে পারেনি। পুলিশ চলে গেলে আবার হামলা হতে পারে। তিনি জানান, হামলাকারীরা সেদিন মন্দিরে ঢুকে দানবাক্সসহ সব মূল্যবান জিনিস লুটপাট করে নিয়ে যায়। প্রমাণ মুছে ফেলতে সিসিটিভির হার্ডডিস্ক খুলে নেয়।
ইসকন মন্দিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল আলিম জানান, তাঁরা সকাল আটটা থেকে রাত আটটা এবং রাত আটটা থেকে সকাল আটটায় দুই ভাগে ভাগ করে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। মাঝেমধ্যে প্যাট্রল টিম এসেও ঘুরে যায়।
চৌমুহনী কলেজ রোডের শশীমতী সাহা বাংলা ম্যাগাজিনকে জানান, ১৫ অক্টোবর দুপুরে হঠাৎ হইচই আর চিৎকার শুনে বাসার নিচে নেমে দেখেন রাস্তা দিয়ে শত শত অল্পবয়সী ছেলে হাতে লাঠি ও রড নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। কয়েক মিনিট পর দেখেন দুজন পুলিশ সদস্য তাঁদের বাড়ির উঠানে। এ সময় তিনি তাঁদের কাছে জানতে চান, হামলা ঠেকানো বাদ দিয়ে তাঁদের উঠানে কেন? তাঁরা উত্তর দেন, ‘দুজন গিয়ে আমরা কীভাবে ঠেকাব। ওরা আমাদেরও মেরে ফেলবে।’
নোয়াখালী জেলা পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, দুর্গাপূজা চলাকালে সহিংসতার ঘটনায় ৩০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২২২ জনকে। এর মধ্যে বেগমগঞ্জে সর্বোচ্চ ১৪টি মামলায় ১৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩০ জনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বর্তমানে তিনজন রিমান্ডে আছেন। হামলা ও সহিংসতার ঘটনায় ৯ জন আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
জানতে চাইলে নোয়াখালীর পুলিশ সুপার শহীদুল ইসলাম জানান, যত পুলিশ ছিল তারা চেষ্টা করেছে। কিন্তু একযোগে হামলা হওয়ায় সব জায়গায় পুলিশ সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি। এখন মন্দিরে মন্দিরে সুরক্ষা কমিটি করা হয়েছে। পুলিশ তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে।