পীরগঞ্জে তাণ্ডবলীলা
থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে রংপুরের পীরগঞ্জ রামনাথপুর ইউনিয়নের ৩ গ্রামে। পেট্রোল ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মন্দিরসহ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ২৫টি ঘরবাড়ি। বসতবাড়ির স্বর্ণালঙ্কারসহ লুট করা হয়েছে দোকানপাট। পীরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও এক রাতেই নিঃস্ব হয়ে গেছে পরিবারগুলো। এখন খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবন তাদের।
গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে দুঃসহ রাতের বর্ণনা দিতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। বিনা অপরাধে ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের বিচার চেয়েছেন তারা। ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে এক কিশোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি পোস্ট করার পর এ সহিংস ঘটনার সূত্রপাত হয়।
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানান, রামনাথপুর ইউনিয়নের মাঝিপাড়ার কিশোর পরিতোষ সরকার রোববার বিকালে ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছবি পোস্ট দেয়। ওই পোস্টটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে এলাকায় চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এক পর্যায়ে বিকালে বটেরহাট মাঝিপাড়ায় পরিতোষের বাড়ি ঘেরাও করে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় একটি মন্দিরসহ আশপাশের বেশকিছু বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় হামলাকারীরা। পরিতোষ সুযোগ বুঝে পরিবারসহ বাড়ি থেকে পালিয়ে যান।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এড়াতে বাদ মাগরিব রামনাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলাম সাদেক ও মসজিদের ইমাম পরিতোষের বাড়িতে ছুটে যান। অবস্থা বেগতিক হলে রাত ৮টায় পুলিশ এসে পরিতোষের পুরো বাড়ি ঘেরাও করে স্থানীয়দের বুঝিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করে। রংপুর পুলিশ লাইন্স থেকে বাড়তি পুলিশ পাঠানো হয় সেখানে।
উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মাঝেই রাত ১০টায় পার্শ্ববর্তী আধা কিলোমিটার দূরে ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত বড় করিমপুর, কসবা ও উত্তরপাড়া এলাকায় ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মন্দির ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়ে লুটপাট করে দুর্বৃত্তরা। এরপর ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে পালিয়ে যায় তারা। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন প্রাণ রক্ষায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, দুর্বৃত্তরা হিন্দু বাড়িগুলো থেকে টাকা, স্বর্ণালংঙ্কার, গবাদিপশু লুটপাট করেছে। শেষে পেট্রোল ঢেলে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
অনেকের মতো ৯ বছরের শিশুটিও হামলাকারীদের তাণ্ডবলীলা দেখেছে। ভয়ে শিশুটি ঘরে থাকতে পারেনি। রাতের অন্ধকারে একা পাশের জঙ্গলের বাঁশে উঠে আশ্রয় নেয়। সেখানে কেটে যায় সারা রাত।শিশুটির মা–ও প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন ধানখেতে। হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর মা পুলিশের অভয় পেয়ে ধানখেত থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন, ঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে।
ভোর পেরিয়ে তখন চারদিকে আলোকছটা। মা খুঁজতে থাকেন বুকের ধন শিশুটিকে। না পেয়ে কান্না জুড়ে দেন। এ সময় অনেকেই নাম ধরে শিশুটিকে ডাকতে থাকেন। একপর্যায়ে শিশুটি বাঁশের আগা থেকে সাড়া দেয়।গ্রামের বাসিন্দা হরিপদ রায় জানান, আতঙ্কিত শিশুটিকে বুঝিয়ে বাঁশের আগা থেকে নামিয়ে আনা হয়। তখন মা তাঁর সন্তানকে বুকে চেপে অঝোরে কাঁদতে থাকেন।শিশুটির মা বলেন, ‘আমি সন্তানকে ফিরে পেয়েছি, আর কিছু চাই না। তবে যারা আমার বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুট করেছে, তাদের শাস্তি চাই।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয়রা জানায়, পরিতোষের বাড়ির পার্শ্ববর্তী গ্রামে হিন্দুবাড়িতে অগ্নিসংযোগের খবর পেয়ে থানা পুলিশ ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস, রংপুর থেকে দাঙ্গা পুলিশ, র্যাব, ১৬ প্লাটুন বিজিবি বড় করিমপুর, কসবা ও উত্তরপাড়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালায়। অবস্থা বেগতিক হলে ১০ রাউন্ড টিয়ার শেল ও ৬১ রাউন্ড শটগানের ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। এ সময় দুর্বৃত্তদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
মধ্য রাতে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এদিকে রাতভর অভিযান চালিয়ে পুলিশ ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করে। এ ছাড়া অপরাধীদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জানমাল রক্ষায় বর্তমানে ওইসব গ্রামে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর গ্রামে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ তুলে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে রোববার রাতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে উত্তেজিত জনতা।পুলিশ ও ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে, হামলাকারীরা অন্তত ১০টি খড়ের পালা ও ২১টি ঘরে অগ্নিসংযোগ করলে তা সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। আগুনে পুড়ে মারা গেছে দুটি গাভি। ৬৫ ঘরে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় তারা।