অস্থির বাজার সহনীয় রাখতে কমানো হচ্ছে নিত্যপণ্য পেঁয়াজ ও চিনির শুল্ক। এ ব্যাপারে কাজ শুরু করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। শুল্ক কমানোর ফলে রাজস্ব আয়ে কী প্রভাব পড়বে, ভোক্তারাই-বা কতটা সুবিধা পাবে, তা নিয়ে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে তারা। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শুল্ক কমানোর সুফল ভোক্তারা পায় না; মূলত এই সুবিধা যায় ব্যবসায়ীদের পকেটে।
নিত্যপণ্যের দাম শিগগিরই কমার বিষয়ে কোনো আশার কথা শোনাতে পারল না বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা ও ব্যবসায়ীকে নিয়ে গতকাল সোমবার এক বৈঠকের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উল্টো জানিয়েছে, পেঁয়াজের বাজার এক মাস ‘একটু নাজুক’ থাকবে।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, যেকোনো পণ্যের দাম বাড়তে থাকলে প্রথমে ব্যবসায়ী বা আমদানিকারকদের মূল লক্ষ্যই থাকে শুল্ক-কর কমানো। নানাভাবে তাঁরা সরকারের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে দেনদরবার করে শুল্ক-কর কমাতে সক্ষম হয়। অথচ যে কারণে শুল্ক-কর কমানো; তার ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করা বা সহনীয় দামে বাজারে পণ্য সরবরাহ বাড়ানো–এটা তেমন একটা দেখা যায় না।
ভোজ্যতেল ও চিনির দাম নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। সূত্র জানিয়েছে, ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর যে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন, তা নিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে (বিটিটিসি) শিগগিরই বৈঠক হবে। সেখানে দাম বাড়ানো নিয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
এনবিআরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সরকারকে অনেক বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়। কখনো কখনো রাজস্ব আয়ের চেয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়াও সরকারের দায়িত্ব। তারই ধারাবাহিকতায় এনবিআরের কর্মকর্তারা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেবেন আসলে কতটুকু কমবে বা কত দিনের জন্য কমবে ইত্যাদি।
বৈঠকে চাল, আটা, ময়দা, মুরগি, গুঁড়া দুধ, সবজি, সাবান, টিস্যু ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম নিয়ে আলোচনা হয়নি।এসব পণ্যের বেশির ভাগ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীনও নয়। সব মিলিয়ে মানুষের জন্য তেমন কোনো স্বস্তির খবর নেই। বরং দুশ্চিন্তার বিষয় এই যে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারদর বাড়তি।
কিছুদিন ধরে পেঁয়াজের দাম লাগামহীনভাবে বাড়ছে। ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ার অজুহাতে বাংলাদেশেও দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। শুধু তা-ই নয়; ভারতে দাম বাড়ার খবর আসতে না আসতেই বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম কেজিতে ২৫ থেকে ৩০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এ পণ্যটির দাম বছরের একটা বিশেষ সময়ে এসে রীতি মেনে বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পণ্যটির শুল্ক চার মাসের জন্য কমাতে চিঠি দেয় এনবিআরকে।
নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় রেস্তোরাঁয় খাবারের দাম বাড়ছে। চায়ের দোকানে এক কাপ চা পান করতে বাড়তি লাগছে এক থেকে দুই টাকা। রুটি-বিস্কুটের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ছাত্রাবাস, মেস, রিকশার গ্যারেজসহ বিভিন্ন জায়গায় খাবারের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। গত রোববারই রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে।
দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভা শেষে অনলাইনে যুক্ত হয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। অন্যদিকে বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষ এবং এনবিআর, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি), ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতারা বৈঠকে সশরীরে অংশ নেন।
সভার শুরুতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান একটি উপস্থাপনায় জানান, বিশ্ববাজারে গত এক বছরে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম তেলের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৭০ ও ৭৬ শতাংশ। বিপরীতে বাংলাদেশে বেড়েছে যথাক্রমে ৪৩ ও ৫৪ শতাংশ। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত চিনির দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশের মতো। দেশে বেড়েছে ২৭ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার শেষ অস্ত্র হিসেবে হয়তো শুল্ক কমায়। তবে শুল্ক কমানোর সুফল যে ভোক্তা পায় না তার প্রমাণ রয়েছে চালের বাজারে। গত বছর চালের সরবরাহ বাড়াতে আমদানির অনুমতি দিয়েও উদ্দেশ্য সফল হয়নি। পরে আমদানি উৎসাহিত করতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর চালের আমদানি শুল্ক প্রথমে ৬২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়।
তাতেও যখন বাজার সহনীয় হয়নি তখন আরেক দফা চালের শুল্ক আরও ১০ শতাংশ কমানো হয়। যদিও ফলন ওঠার পর সরকার চালের শুল্ক বাড়িয়ে আবারও সাড়ে ৬২ শতাংশ করে। সম্প্রতি আবার চালের বাজারে অস্থিরতা বাড়লে শুল্ক কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামানো হয়েছে। তাতেও বাজার যে খুব সহনীয় অবস্থায় রয়েছে, তা বলা যাবে না। এভাবে শুল্ক কমিয়ে ভোক্তাকে যে এর সুফল দেওয়া যায়নি—ভোক্তা ও বিশ্লেষকেরা প্রতিনিয়তই এ অভিযোগ করে যাচ্ছেন।