তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধ হবে পানি নিয়ে উক্তিটি পোপ ফ্রান্সিসের। আর জাতিসংঘের প্রকাশিত প্রতিবেদনও এরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। পৃথিবীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ক্রমাগত বাড়ছে সুপেয় পানির চাহিদা। কিন্তু সেই সঙ্গে আনুপাতিক হারে বাড়ছে না পানি।
গতকাল মঙ্গলবার জাতিসংঘের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের ৫০০ কোটির বেশি মানুষ পানির সংকটে ভুগতে পারে। চলতি মাসের শেষে শুরু হতে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি।
জাতিসংঘের অধীনস্থ ওয়ার্ল্ড মেটিরিওলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) সংস্থাটির সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে দ্রুত হারে জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে। এর ফলে পৃথিবীর জলস্তর উদ্বেগজনক ভাবে নীচে নেমে যেতে শুরু করেছে। ভূপৃষ্ঠ, ভূপৃষ্ঠের ঠিক নীচের স্তর, বরফ ও তুষারে জমা জলের স্তর গত দু’দশকে যে হারে কমেছে তা আগে কখনও হয়নি।
এ নিয়ে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে পানি সম্পর্কিত দুর্যোগ যেমন খরা, বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে। সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত এই দুর্যোগে ভুক্তভোগী মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে।জাতিসংঘের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) সম্প্রতি নতুন এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০১৮ সালে কমপক্ষে এক মাস অপর্যাপ্ত পানি পায় ৩.৬ বিলিয়ন মানুষ।
গত ২০ বছরে এই জলস্তর ফিবছরে ১ সেন্টিমিটার করে নেমে যাচ্ছে। রিপোর্টটির নাম দেয়া হয়েছে, ‘দ্য স্টেট অব ক্লাইমেট সার্ভিসেস ২০২১: ওয়াটার’। এই আসন্ন পানি সংকট থেকে কী ভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে তাবে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আসন্ন বিশ্ব সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের আলোচনা করারও আহবানও জানানো হয়েছে রিপোর্টে।আগামি ৩১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত জাতিসংঘের ‘সিওপি-২৬’ শীর্ষক শীর্ষ সম্মেলন হবে গ্লাসগোতে।
অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে বিশ্বের নিম্ন অক্ষাংশে থাকা জনবহুল এলাকায়ও উল্লেখযোগ্যভাবে পানির পরিমাণ কমছে, যা ঐতিহ্যগতভাবে পানি সরবরাহ করত।বিশ্বে মোট পানির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ পানি ব্যবহারযোগ্য।
গত ২০ বছরেও বিশ্বে পানির সংকট বেড়েছে। ২০০০ সাল থেকে বন্যাসংশ্লিষ্ট দুর্যোগ বিশ্বে আগের থেকে ১৩৪ শতাংশ বেড়েছে। আর এর বেশির ভাগই হয়েছে এশিয়ায়।এই সময়ে খরার পরিমাণও ২৯ শতাংশ বেড়েছে। আর খরার কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় আফ্রিকার দেশগুলোকে।
ওই রিপোর্ট আরো বলা হয়েছে, ২০১৮ সাল থেকেই পানি সংকটে আছেন বিশ্বের ৩৬০ কোটি মানুষ। বছরে যারা অন্তত এক মাস পানি সংকটে থাকেন তাদেরকেই এই তালিকায় রাখা হয়েছে। কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ৩৬০ কোটি থেকে বেড়ে ৫০০ কোটিতে পৌছাবে এ সংখ্যা। তাও ২০৫০ সালের মধ্যেই৷
ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা ৯৪০ থেকে ১০২০ কোটিতে গিয়ে পৌঁছাবে। এই সময়ে প্রতি তিনজনে দুজন শহরে বাস করবে। সেই সুবাদে বিশুদ্ধ পানির চাহিদা বহুগুন বেড়ে যাবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পানির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। এর মধ্যে আবার জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জলজ অঞ্চলগুলো আরো প্লাবিত হবে এবং শুষ্ক অঞ্চলগুলো আরো শুষ্ক হবে। তাই পানির এই চাহিদা আরো বাড়বে।
পানি সংকট দেখা দেবে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম অংশ, ভূমধ্যসাগর, উত্তর ও দক্ষিণ আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায়। চরম জলাভাবে ভুগবে দক্ষিণ-পূর্ব অস্ট্রেলিয়াও। এ নিয়ে ডব্লিউএমও-র প্রধান পেত্তেরি তালাস বলেন, পানির স্তরের এই পরিবর্তন সব থেকে বেশি হয়েছে অ্যান্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ডে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জনসংখ্যার বেশি ঘনত্বের এলাকাগুলিতেও জলস্তরের এই নিম্নগামী অবস্থা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা আরও চিন্তার বিষয় কারণ পৃথিবীর মোট সঞ্চিত পানির মাত্র ০.৫ শতাংশ ব্যবহারযোগ্য। বাকিটা ব্যবহার করা আদৌ সম্ভব নয়। সেই পানি অনেক গভীরে রয়েছে বলে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, উন্নত দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে যথেচ্ছাচার করেছে, তাতে প্রকৃতি রুষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রকৃতি একটি জীবন্ত সত্তা, তাকে শুধু সম্পদ লাভের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। অথচ এ বিষয়টিকে আমলে না নিয়ে উন্নত দেশগুলো নিজেদের তথাকথিত উন্নয়নের স্বার্থে জলবায়ু তহবিল, কার্বন ট্রেড প্রভৃতি তৈরি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে টোপ দিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, জলবায়ু সম্মেলনগুলোর মূল সুরে সমস্যা সমাধানের কোনো ব্যাপার থাকে না। কারণ, এর মধ্য দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। কিন্তু এমন একটা ভাব করা হয় যে সমস্যাটি আমলে নেওয়া হয়েছে। কথা হচ্ছে, দুনিয়ার উন্নয়নের মডেল যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা না করে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।