বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির বিমান এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এটি কোনো প্রথাগত যুদ্ধ নয়। একে অন্যকে মিলিটারি ও টেকনোলজিক্যাল দিক দিয়ে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা মাত্র। এই যুদ্ধে এগিয়ে থাকতে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৬ সালে নামক একটি গোয়েন্দা বিমান বানায় যা সোভিয়েত আকাশসীমায় ঢুকে গোপনে ছবি তুলে নিয়ে আসতো। ১৯৬০ সালে ৭০ হাজার ফুট উপর থেকে ছবি তোলার সময় সোভিয়েত এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল হামলায় একটি ইউ-২ বিমান ভূপাতিত হয়। এর পাইলট গ্রেফতার ও জেলে যাওয়ার ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের আকাশে ৮৫ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ছে একটি মার্কিন গোয়েন্দা বিমান। নিখুঁতভাবে তুলে নিল রাস্তায় অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলতে থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির গাড়ির নাম্বার প্লেটের ছবি! শত্রুবিমান অনুপ্রবেশের বিষয়টি টের পেয়ে মিসাইল ছুড়ল সোভিয়েত এয়ার ডিফেন্স ব্রিগেড, আকাশে উড়ল সুপারসনিক যুদ্ধবিমান। কিন্তু কেউই কালোপাখির নাগাল পেলো না। কেননা বিমানের গতি যে মিসাইলের চেয়েও বেশি!
এর পরেই রিকন বিমানের বদলে স্যাটেলাইট ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয় এবং করোনা স্পাই স্যাটেলাইট’প্রোগ্রাম ত্বরান্বিত হয়।এই স্যাটেলাইট সংক্রান্ত বিস্তারিত আর্টিকেলে উল্লেখ করা হয় যে করোনা স্যাটেলাইট দিয়ে সবসময় গোয়েন্দাগিরি করা সম্ভব ছিল না। তাই নতুন ধরনের গোয়েন্দা বিমানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৪ সালে তৈরি হয় long-range, high-altitude, high speed শ্রেণীর রিকনসিস বিমান SR-71।
মার্কিন বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লকহিড করপোরেশনের তৈরি এই বিমানের ডাকনাম ছিল Blackbird যা শব্দের গতির ৩.২ গুণ গতিতে ছুটতে সক্ষম ছিল! এর চেয়ে দ্রুতগতির জেট ইঞ্জিন চালিত বিমান পৃথিবীতে আর একটিও তৈরি হয়নি। এসআর-৭১ মার্কিন এয়ারফোর্স থেকে অবসর নেয়ার পর NASA এর মহাকাশ গবেষণা প্রোগ্রামেও ভূমিকা রেখেছিল। বর্তমানে ড্রোন দিয়ে যে ধরনের নজরদারি করা হয়, তৎকালে এসআর-৭১ সেই কাজটি করত। SR মূলত Strategic Reconnaissance এর সংক্ষিপ্ত রূপ।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ গতির ইন্টারসেপ্টর (ম্যাক ২.৮৩) বিমান মিগ-২৫ যুদ্ধবিমান ১৯৮৭ সালে বাল্টিক সাগরে এক ইঞ্জিন নষ্ট হওয়া এসআর-৭১ এর পিছু ধাওয়া করে টার্গেট লক করে ফেলেছিল। কিন্তু মিসাইল ফায়ারের আগেই সুইডিশ এয়ারফোর্সের চারটি যুদ্ধবিমান ব্ল্যাকবার্ডকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসে। এই ঘটনা ব্যতীত বিমানটিকে শত্রুরা নাগালে পেয়েছে এমন কোনো উদাহরণ নেই।
উল্লেখ্য, ব্ল্যাকবার্ডের চেয়ে বেশি গতির বিমান হলো এক্স-১৫। কিন্তু সেটি জেট ইঞ্জিন নয়, রকেট ইঞ্জিন চালিত। আবার এক্স-১৫ সাধারণ বিমানের মতো সরাসরি আকাশে উড়ত না। বি-৫২ বোমারু বিমানের ডানায় করে একে নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিয়ে লঞ্চ করা হতো। এজন্য ৬.৭০ ম্যাক বা ৭,২৭৪ কি.মি./ঘন্টা গতির এক্স-১৫ কে মজা করে মানুষ চালিত মিসাইলও বলা হয়। তাই এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ডকেই সর্বোচ্চ গতির বিমানের খেতাব দেয়া হয়।
১৯৭৪ সালে ঘন্টায় ২,৯০৮ কি.মি. (ম্যাক ২.৭২) গতিতে উড়ে মাত্র ১ ঘন্টা ৫৫ মিনিটে নিউ ইয়র্ক থেকে লন্ডনে (দূরত্ব ৫,৫৭০ কি.মি.) উড়ে গিয়েছিল একটি ব্ল্যাকবার্ড। তৎকালে কনকর্ড সুপারসনিক যাত্রীবাহী বিমান একই পথে প্রায় তিন ঘন্টা সময় নিত। এর আগে ১৯৭১ সালে সাড়ে দশ ঘন্টায় ২৪ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়েছিল ব্ল্যাকবার্ড! ১৯৮৮ সালে পেন্টাগনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে এসআর-৭১ বিমানগুলোকে অবসরে পাঠানোর দুই বছরের মাথায় আবারও সার্ভিসে আনা হয়। ১৯৯৮ সালে মার্কিন এয়ারফোর্স থেকে অবসরের পর নাসাতে নভোচারীদের টেস্ট ফ্লাইটের কাজে কিছুদিন ব্যবহার হয়।
এসআর-৭১ ছিল প্রথম যুগের স্টেলথ বিমান। এর রাডার ক্রস সেকশন (RCS) এর মান মাত্র দশ স্কয়ার মিটার। আজকের যুগে এটি সাধারণ ব্যাপার হলেও পঞ্চাশ বছর আগে এটিই ছিল বিস্ময়। আধুনিক ড্রোন ও স্পাই স্যাটেলাইটের যুগে এ ধরনের গোয়েন্দা বিমানের চাহিদা শেষ হয়ে গেছে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। যুক্তরাষ্ট্র বহু আগে থেকেই ব্ল্যাকবার্ডের উত্তরসূরি এসআর-৭২ বানানোর কাজ করছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৫ সালে এটি আকাশে উড়বে। তবে ব্ল্যাকবার্ড ছিল তার যুগের তুলনায় কয়েকগুণ এগিয়ে থাকা কিংবদন্তি। এর সমতুল্য কোনো বিমান আজ অবধি কোনো দেশ বানিয়ে দেখাতে পারেনি। একে এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ারিং জগতের বিস্ময় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।