চিসাকো কাকেহি। বয়স তাঁর এখন ৭৪ বছর। জাপানি এই নারীর নেশাই প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর খুন করা। বিধবা হওয়ার পর ২০০৭ সালে তাঁর বয়স যখন ৬১, তখন থেকে তিনি এ ভয়ংকর অপরাধের পথে পা বাড়ান। একে একে তিনজনকে সায়ানাইড খাইয়ে খুন করেন। সর্বশেষ ২০১৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর খুনের শিকার হন ৭৫ বছর বয়সী ইসাও কাকেহি। সম্প্রতি আদালতে তাঁর অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। অনেক দিন ধরে আলোচনায় থাকলেও আদালতের রায়ের পরই মূলত কাকেহির জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।
চিসাকো কাকেহির জন্ম জাপানের দক্ষিণ পশ্চিমের জেলা সাগায়। কাজ করতেন একটি প্রিন্টিং ফ্যাক্টরিতে। ১৯৬৯ সালে প্রথম বিয়ে করেন তিনি। ১৯৯৪ সালে তাঁর স্বামী অসুস্থতার কারণে মারা যান। ২৫ বছর সংসার করার পর একা হয়ে পড়েন কাকেহি। ২০০৭ সালে তোশিয়াকি সুহিরো (৭৮) নামে বিপত্মীকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান কাকেহি। ওই বছরই তিনি প্রেমিক সুহিরোকে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট বলে সায়ানাইডের ক্যাপসুল খাইয়ে দেন। সুহিরোর সন্তানদের সঙ্গেই দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন তাঁরা। এর কিছুক্ষণ পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
কাকেহি নিজেই সুহিরোর সঙ্গে হাসপাতালে যান। তবে পরিচয় গোপন করেন তিনি। অ্যাম্বুলেন্স কর্মীদের কাছে নিজে নাম বলেন ‘হিরাওকা’। সায়ানাইড খাওয়ার পরও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন সুহিরো। তবে সেই বেঁচে থাকা দীর্ঘ হয়নি। স্নায়ুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ঘটনার মাত্র দেড় বছর পর মারা যান তোশিয়াকি সুহিরো।
সুহিরোকে ছাড়ার পর নতুন প্রেমের খোঁজে নামেন চিসাকো কাকেহি। মাসানোরি হোন্ডার সঙ্গে ২০১১ সালে প্রেমের সম্পর্ক শুরু করেন। ২০১২ সালে হাসপাতালে মৃত্যু হয় এই ব্যক্তির। আদালতের বর্ণনা অনুযায়ী, মাসানোরি হোন্ডাকে বিয়ের কোনো পরিকল্পনাই ছিল না এই নারীর। হোন্ডার সঙ্গে প্রেম চলাকালে আরেক ব্যক্তির সঙ্গে গোপনে প্রেম করছিলেন তিনি।
এরপর চিসাকো নজর দেন ফুসফুসের ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করতে থাকা মিনোরু হাইওকির দিকে। রেডিও থেরাপি নয়ে হাইওকির ক্যানসার প্রায় সেরে যায়। তাঁর স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি ঘটে। তাই ৭৫ বছর বয়সে তিনি নতুন জীবন শুরু করার আশায় কাকেহির সঙ্গে প্রেমে জড়ান। হাইওকি চেয়েছিলেন প্রেম, কিন্তু কাকেহির পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। ২০১৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্রেমিকা চিসাকোর সঙ্গে নৈশভোজে গিয়ে মৃত্যু হয় মিনোরু হাইওকির।
সর্বশেষ ইসাও কাকেহির সঙ্গে প্রেম শুরু করেন চিসাকো। বিয়ের কয়েক সপ্তাহ পরেই চিসাকো তাঁর স্বামীকে সায়ানাইড খাইয়ে হত্যা করেন।জাপানে সাধারণত মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়। খুব সন্দেহ না হলে কর্তৃপক্ষ মরদেহ কাটাছেঁড়া করে না। কিন্তু ইসাওর মৃত্যুতে কাকেহিকে সন্দেহ করতে শুরু করে পুলিশ। ময়নাতদন্তে ইসাওর হৃদ্যন্ত্র, রক্ত ও পাকস্থলীতে প্রচুর পরিমাণ সায়ানাইড আয়ন শনাক্ত করা হয়।
মার্কিন সম্প্রচার মাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবারই খুনের ঘটনা ঘটিয়ে কোনো না কোনোভাবে পার পেয়ে যেতেন কাকেহি। সর্বশেষ ইসাও কাকেহির মৃত্যুর পর তাঁর সম্পর্কে প্রশাসনের সন্দেহ প্রবল হয়। পুলিশের তদন্তের সূত্র ধরে বেরিয়ে আসে চিসাকো কাকেহির ধারাবাহিক খুনের কাহিনি। এই নারীকে ২০১৪ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আদালতে তিন প্রেমিককে সায়ানাইড খাইয়ে হত্যার কথা স্বীকার করেন কাকেহি।
পুলিশ অভিযান চালিয়ে চিসাকো কাকেহির ঘর থেকে সাপ্লিমেন্ট পিল জব্দ করে। ধারণা করা হয়, হেলথ সাপ্লিমেন্ট খালি করে সেখানে সায়ানাইড ভরেছিলেন চিসাকো কাকেহি। একই রকম দেখতে হওয়ায় এই ক্যাপসুল নিয়ে সন্দেহ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কাকেহি এই সায়ানাইড সংগ্রহ করেছিলেন তাঁর সাবেক কর্মস্থল প্রিন্টিং কারখানা থেকে।
তিন প্রেমিককে খুন ও একজনকে খুনের চেষ্টার অভিযোগে ২০১৭ সালে কাকেহিকে মৃত্যুদণ্ড দেন জাপানের আদালত। তবে রায় এখনো কার্যকর হয়নি। জাপানের সংবাদমাধ্যম এনএইচকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে বিচারক জানান, ম্যাচমেকিং এজেন্সির মাধ্যমে বয়স্ক বিপত্নীক পুরুষদের খুঁজে নিতেন কাকেহি। তাঁর ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর এখন বয়স্ক সিঙ্গেলরা অনলাইনে সঙ্গী খোঁজাটা অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে মনে করছেন।
এসব খুনের পেছনে টাকা হাতিয়ে নেওয়াই ছিল মুখ্য কারণ। কাকেহি যার যার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন সম্পদশালী। ভুক্তভোগী চারজন পুরুষ জাপানের ভিন্ন ভিন্ন শহরের বাসিন্দা ছিলেন। জানা গেছে, প্রথম শিকার সুহিরোর কাছ থেকে ৪৮ মিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা) ধার নিয়েছিলেন চিসাকো। আদালতের ধারণা, এই টাকা পরিশোধের দায় এড়াতেই তিনি খুনের পথ বেছে নেন। খুনের ঘটনার পর কাকেহি তাঁর সন্তানদের জানিয়েছিলেন, তিনি তাঁর ঋণ শোধ করেছেন। কাকেহি তাঁর আরেক প্রেমিক মাসানোরি হোন্ডার থেকে হাতিয়ে নেন ১৬ মিলিয়ন ইয়েন (১ কোটি ২৫ লাখ টাকা)।
আসাহি নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চিসাকো কাকেহি প্রেমের ফাঁদে ফেলে সঙ্গীদের কাছ থেকে আনুমানিক ৫০০ মিলিয়ন ইয়েন (৩৮ কোটি ৫৩ লাখ টাকা) হাতিয়ে নিয়েছেন। চিসাকোর আইনজীবীরা অবশ্য আদালতে বলেছেন, চিসাকো ডিমেনশিয়ায় (নিদ্রাহীনতা) ভুগছেন। যদিও আদালতে এই আপিল টেকেনি। কাকেহির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন আদালত।