অপরাধঅর্থ ও বাণিজ্যঢাকা

ইউনিয়ন ব্যাংকের ভল্টের ১৯ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না

ইসলামি ধারায় পরিচালিত বেসরকারি খাতের ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখার ভল্টের টাকার হিসাব মিলছে না। কাগজপত্রে ওই শাখার ভল্টে যে পরিমাণ টাকা থাকার তথ্য রয়েছে, বাস্তবে তার চেয়ে প্রায় ১৯ কোটি টাকা কম পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা গত সোমবার ওই শাখা পরিদর্শনে গিয়ে ভল্ট খুলে টাকা গুনে কাগজপত্রের সঙ্গে বাস্তবে বড় ধরনের গরমিল পান।  

শাখাটির নথিপত্রে দেখানো হয়েছে, ভল্টে ৩১ কোটি টাকা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা গুনে পেয়েছেন ১২ কোটি টাকা। বাকি ১৯ কোটি টাকার ঘাটতি সম্পর্কে শাখাটির কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলকে যথাযথ কোনো জবাব দিতে পারেননি।

 নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ভেদ করে ব্যাংকের গুলশান শাখার ভল্ট থেকে টাকা উধাওয়ের ঘটনায় তোলপাড় তৈরি করেছে। গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল এমন তথ্য উদঘাটন করে।তাৎক্ষণিকভাবে কোনো জবাব দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এরপর বিষয়টি ধামা চাপা দিতে নানা তৎপরতা শুরু হয়।এ নিয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ইউনিয়ন ব্যাংকের ভল্টের টাকায় গরমিল হতে পারে, উধাও বলা যাবে না। আমার অ্যাকাউন্টে দুই লাখ থাকার কথা, সেখানে এক লাখ ৯০ হাজার হতে পারে এটাও একটা হিসাবের গরমিল, সেটা যে পরিমাণ টাকাই হোক না কেনো। কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে ভল্টের টাকায় গরমিলের মতো প্রমাণ যদি বাংলাদেশ ব্যাংক পাই, তবে অবশ্যই যথাযথ নিয়ম মেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আমি শিউর না, ব্যাপারটা সম্পর্কে আমি এখনও তেমন কিছু জানি না। আসলে ব্যাংকটির কী গরমিল আছে জানি না, ভল্টে কম-বেশি হয়ে গেছে বা হয়ে থাকলে সেটাও ফল্ট। সুতরাং, এ ফল্ট যদি কোনো ব্যাংক করে তাহলে রুলস অ্যান্ড রেগুলেটরি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক।’

নিয়ম অনুযায়ী, ভল্টের টাকার গরমিল থাকলে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হয়। কিন্তু গতকাল বুধবার পর্যন্ত ব্যাংকটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এ ধরনের কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকেও বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয়নি। তবে ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, ভল্ট ডাকাতির কথা শোনা গেলেও, ভল্টে ঘোষণার চেয়ে কম টাকা পাওয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে খুব বেশি শোনা যায়নি।  

ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড বাংলাদেশের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক, যেটি মূলত ইসলামি ব্যাংকিং ব্যবসায় জড়িত। এই ব্যাংকটি ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়।এর আগে চলতি বছর ১৭ জুন ঢাকা ব্যাংকের বংশাল শাখার ভল্ট থেকে চার কোটি টাকা লুট হয়েছিল। কয়েক মাস আগে ডাচ বাংলা ব্যাংক থেকে ব্যাংকটির একজন আইটি অফিসার এক হাজার ৩৬৩টি লেনদেনের মাধ্যমে দুই কোটি ৫৭ লাখ সরিয়ে নিয়েছিলেন। ঘটনাটি ব্যাংকের অডিটে ধরা পড়ে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগের একজন যুগ্ম পরিচালকের নেতৃত্বে একটি দল নিয়মিত বিশদ পরিদর্শনের অংশ হিসেবে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের নিচে অবস্থিত গুলশান শাখায় যায়। পরিদর্শনের প্রথম দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা ভল্টে রাখা টাকার হিসাব মিলিয়ে দেখেন। সেটি করতে গিয়েই ব্যাংকটির ওই শাখায় ১৯ কোটি টাকার গরমিলের বিষয়টি ধরা পড়ে।

ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী, ভল্টের চাবি থাকে দুজনের কাছে। শাখা ব্যবস্থাপক, শাখা পরিচালনা ব্যবস্থাপক, ক্যাশ ইনচার্জ ও ক্যাশ অফিসার—এ চার পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে যেকোনো দুজনের কাছে চাবি থাকবে। দুজনের উপস্থিতি ও চাবি ছাড়া ভল্ট খোলা ও বন্ধের সুযোগ নেই। প্রতিদিন লেনদেন শেষে ঠিক কত টাকার কতটি নোট ভল্টে জমা রাখা হচ্ছে, তা নির্দিষ্ট রেজিস্টার খাতায় লিপিবদ্ধ করতে হয়। সেই খাতাও থাকে ভল্টের ভেতরে।

টাকার হিসাব মেলার পর কর্মকর্তারা প্রতিদিন ওই রেজিস্টারে স্বাক্ষর করেন। তাই ভল্টের টাকার গরমিলের সুযোগ কম। শাখা ব্যবস্থাপক ও প্রধান শাখার কর্মকর্তারা হঠাৎ হঠাৎ ভল্ট পরিদর্শন করে টাকার হিসাব মিলিয়ে দেখেন। গরমিল পাওয়া গেলে দায়িত্বপ্রাপ্তদের জবাবদিহি করতে হয়। সন্তোষজনক জবাব পাওয়া না গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলার বিধান রয়েছে।

ইউনিয়ন ব্যাংকের ২০২০ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর ব্যাংকটিতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতই ৪ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। ওই বছর শেষে ব্যাংকটির বিনিয়োগ (ঋণ) ছিল ১৬ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। গত বছর ব্যাংকটি ৯৮ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে। গত বছর ব্যাংকটির শাখা ছিল ৯৫টি।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক মঈনউদ্দীন বলেন, নথিতে থাকার হিসাব বা ঘোষণার এক পয়সাও ভল্টে কম থাকার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো গরমিল হয়, তাহলে বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশকে অবহিত করতে হয়। যদি কোনো ব্যাংক সেটি না করে, তবে বুঝতে হবে সেখানে কোনো সমস্যা আছে।

Back to top button