জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে ‘প্রতারণাও’ ইদানীং ডিজিটাল রূপ পেতে শুরু করেছে। এখন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড যেমন জালিয়াতি করে অন্যের অ্যাকাউন্ট খালি করা হচ্ছে, তেমনি গলা কাটা পাসপোর্ট তৈরি, বিদেশি ভুয়া ওয়ার্কিং পারমিট ও নিয়োগপত্র প্রস্তুত করলেও সহজে তা জাল প্রমাণের উপায় থাকে না।
জাল টাকার ছড়াছড়ি আছে বাজারজুড়ে। মোবাইল ফোনে লাখ লাখ টাকা লটারি পাওয়ার প্রলোভনযুক্ত মেসেজ বানিয়েও প্রতারণা করা হচ্ছে অহরহ। আছে বিকাশ প্রতারণা ভূরিভূরি। নানা কূটকৌশল-বুদ্ধির ফাঁদে শুধু যে গ্রামীণ এলাকার সহজ-সরল মানুষজনই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা নয়, শহুরে শিক্ষিত সচেতন বাসিন্দারাও এসব প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব খুইয়ে চলছেন অহরহ। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে প্রতারণার নানা বেহালচিত্র।
দেখা গেছে, খোদ রাজধানীতেই প্রতিনিয়ত চলছে কমবেশি ৭০ থেকে ৭৩ রকমের প্রতারণা। সন্তান প্রসব থেকে শুরু করে শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি, বিয়ে এমনকি মৃত্যুর পর লাশ দাফন- সব ক্ষেত্রেই প্রতারণার একচ্ছত্র দাপট রয়েছে। সাংবাদিক হিসেবে ভুয়া পরিচয় দিয়ে প্রতারণাও করছেন অনেকে।
ঘর থেকে দুই পা ফেলতেই হরেক প্রতারণার বেড়াজালে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। ডিজিটাল, অ্যানালগ সব প্রতারণায় মানুষের জীবন বিপর্যস্ত।শুধু বাইরে নয়, ঘরেও থাকা যাচ্ছে না নিরাপদ। ডিজিটাল দুনিয়ার বড় অংশ জুড়েই প্রতারণার ফাঁদ। ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানামুখী অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে যা খুশি তা হচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে অভিযোগের শেষ নেই। নারী, শিশু ও সম্মানিত মানুষেরা অনলাইনে নানাভাবে হয়রানির শিকার। ডিজিটাল প্রতারণা নিয়ে অভিযোগের পাহাড় পুলিশ, র্যাবে।
কখনো সুপরিচিত কোনো নারীর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ছবি নিয়ে ফেক আইডি খুলে তাতে আপলোড করা হচ্ছে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও। ফেসবুকে ই-কমার্স পেজ খুলে বিশাল মূল্যছাড়ের লোভ দেখিয়ে ক্রেতা থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্যই পাঠানো হচ্ছে না। আবার কখনো সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাতিমান ব্যক্তি বা তারকাদের নিয়ে আপত্তিকর ও বানোয়াট ভিডিও বানিয়ে ছাড়া হচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউবে। পরে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা।
জীবনযাত্রার সব ক্ষেত্রই প্রতারণার অক্টোপাসে বন্দী হয়ে পড়ছে, পদে পদে ওত পেতে থাকছে নানামুখী বিপদ। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নানা রকমের অন্তত ২০০ প্রতারক সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে এবং তাদের কাছে প্রতিদিন সহস্রাধিক লোক প্রতারণার শিকার হন। ডিএমপিভুক্ত থানাগুলোর লিপিবদ্ধ মামলা-জিডি ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতারণার খবরের সূত্র ধরে এ পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে।
প্রতারকরা নারীসম্পৃক্ত নানা অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি টাকাপয়সা হাতিয়ে নেওয়ার মওকা পাচ্ছেন। নানা প্রলোভনে নতুন কৌশলে অপহরণ-মুক্তিপণ আদায় ও ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটাচ্ছে দুর্র্ধর্ষ নারী অপরাধী চক্র। কখনো কখনো গায়ে পড়েই কারও সঙ্গে বিবাদ সৃষ্টি করছেন, ‘কু’ প্রস্তাব দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলেও পথেঘাটে বিভিন্ন টার্গেট ব্যক্তিকে জিম্মি করে টাকা আদায় করছেন এ চক্রের সদস্যরা।
নারী অপরাধী সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিভিন্ন কৌশলে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ফাঁদে ফেলে এবং নিয়মিত ব্ল্যাকমেলিং করে চাহিদামাফিক সবকিছু হাতিয়ে নেন। সম্মানী ব্যক্তিদের কাছে নারী সিন্ডিকেট সবচেয়ে ভয়ংকর আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাটকে, ফিল্মে অভিনয়ের জন্য অনেকেই মরিয়া। তরুণ-তরুণীদের এ রকম স্বপ্ন ও সাধকে পুঁজি করে অনেকেই প্রতারণার ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। নাটক ও সিনেমার লাইনে টাকা ঢেলে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে। লম্পটদের খপ্পরে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন তরুণীরা। রঙিন স্বপ্নে বিভোর হয়ে তারা সর্বস্ব খুইয়ে দেন। কারও কারও পরিণতি হয় আরও ভয়াবহ। নিরুপায় হয়ে তাদের সোসাইটি গার্ল বা কলগার্লের জীবন বেছে নিতে হয়, কারও কারও জীবনে নেমে আসে আরও ভয়ংকর অন্ধকার। এমনকি জীবন হারানোর ঘটনাও ঘটে অহরহ।
সুন্দরী নারীদের সঙ্গে নিয়ে ম্যারেজ মিডিয়ার ছদ্মাবরণে গড়ে তোলা প্রতারক চক্রের মূল টার্গেট হচ্ছেন ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী এবং সরকারি কর্মকর্তারা। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত লোকজন প্রতারণার শিকার হলে অনেকেই সামাজিক সম্মানের কারণে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চান না।
মাত্র ১০ হাজার টাকা বুকিং দিলেই ফ্ল্যাটের মালিক হওয়া যাবে। আবার ৩ লাখ টাকা দিয়েই কক্সবাজার কিংবা কুয়াকাটা সি-বিচে পাঁচ তারকা হোটেলের অংশীদার হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ! ইত্যাদি লোভনীয় বিজ্ঞাপন প্রচার করে শত শত লোক থেকে বিনিয়োগের টাকা সংগ্রহ করে নিচ্ছে বিভিন্ন ভুঁইফোড় কোম্পানি। একপর্যায়ে ফ্ল্যাটের কথিত দলিলও হস্তান্তর করা হয়, কিন্তু বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও পাঁচ তারকার হোটেল সুইট থেকে আয়ও করতে পারে না, ফ্ল্যাটও নিতে পারে না কেউ।
ইমিগ্র্যান্ট ভিসার লোভ দেখিয়ে সর্বস্বান্ত করা হয়েছে অনেককে। বেকার যুবক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তাও রয়েছেন এ তালিকায়। তাদের থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় ৪ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। কানাডার ইমিগ্র্যান্ট ভিসা দেওয়ার নামে অভিনব কায়দায় টাকা নেওয়া হয়। প্রতারিতরা বিষয়টি নিয়ে চাপ সৃষ্টি করলে অনেককে চেক দিয়ে সান্ত্বনা দেওয়া হয়। পরে আকরাম টাওয়ার, পুরানা পল্টন, ফার্মগেট, বনানীসহ অন্যান্য অফিস রাতের আঁধারে গুটিয়ে নিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যরা পালিয়ে যান।
এদিকে ফেসবুক ট্রাভেলার গ্রুপ খুলে ভয়ংকর প্রতারণার ফাঁদ পাতছে আরেকটি চক্র। এরা বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে নানা পন্থায় হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতার সুযোগে ভুক্তভোগী এক যুবককে আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত বিপণন প্রতিষ্ঠান অ্যামাজন, ইবের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসার প্রস্তাব দেন প্রতারক জাকারিয়াসহ তার সহযোগীরা।
তারপরই ডোমেইন কেনানো, ওয়েবসাইট বানানোর নামে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয় ওই যুবকের। ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের ওয়েব বেজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিমের একজন কর্মকর্তা জানান, যত বেশি ডোমেইন তত বেশি মুনাফার প্রলোভন, একে একে ৪২টি ডোমেইন বিক্রি করে এক ব্যক্তি থেকেই হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে ৩০ লক্ষাধিক টাকা।
বিভিন্ন রোগকে পুঁজি করেও চলছে জমজমাট প্রতারণা ব্যবসা। এসবের মধ্যে গোপন রোগের চিকিৎসা সবচেয়ে বেশি হিট।বিদেশগামী অনেক শ্রমিকের বেলায় দেখা গেছে, এজেন্টরা টাকা নিয়ে শ্রমিকদের গলা কাটা পাসপোর্ট ধরিয়ে দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট দেশের ভিসার নকল জলছাপ ও লোগো এত সুন্দর করে প্রতারকরা পাসপোর্টে বসিয়ে দেন যে মনে হবে অরিজিনাল। বিষয়টি শেষমেশ ধরা পড়ে এয়ারপোর্ট পাস করার মুহূর্তে। ততক্ষণে শত শত শ্রমিকের লাখ লাখ টাকা নিয়ে প্রতারক চক্র উধাও।
প্রতারকদের কল্যাণে গ্রাহকরা ফা, ডেভিডফ, ভার্সাচি, নাইকি, অ্যাডিডাস ইত্যাদি বিশ্বমানের যে কোনো পণ্য ফেলনা দামে রাজধানীর ফুটপাথ থেকেই সংগ্রহ করতে পারছেন। বিশ্বের এমন কোনো ব্র্যান্ডের পণ্য নেই যা ফার্মগেটের ফুটওভার ব্রিজ বা গুলিস্তানের ফুটপাথে পাওয়া যায় না। ‘বাটা’ জুতার ‘রাটা’ সংস্করণ, ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’র জায়গায় ‘কেয়ার অ্যান্ড লাভলি’ও সুলভে মেলে! প্রতারকরা তাদের কাজে এতটাই সিদ্ধহস্ত তাদের প্রতারণা রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
নানা বুদ্ধির কৌশলে প্রস্তুতকৃত প্রতারণার ফাঁদে শুধু যে গ্রামীণ সহজ সরল, অজ্ঞ-অসচেতন মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা নয়, শহুরে শিক্ষিত সচেতন বাসিন্দারাও এসব প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব খুইয়ে চলেছেন অহরহ।