শাহীন আলমের নগ্ন ভিডিও’র ফাঁদ

কলেজপড়ুয়া তরুণী সিনথিয়া পারভীন (ছদ্মনাম)। দেখতে সুন্দরী-স্মার্ট। কথা বলেন মিষ্টি সুরে। বছরখানেক আগে এক আত্মীয় তাকে একটি স্মার্টফোন গিফট্‌ করেন। তারপর খুলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। ফেসবুকে নানা ভঙ্গির ছবি আপলোড করতেন নিয়মিত। ফেসবুক বন্ধুরা তাতে অসংখ্য লাইক-কমেন্ট করেন। এতে আগ্রহ পান তরুণী।

তার প্রোফাইলে সুন্দর ছবি দেখে অনেকেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠান।বন্ধু তালিকার মধ্যে এক যুবকের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা শুরু হয় তরুণীর।যুবকের সঙ্গে নিয়মিত কথা হওয়ায় ধীরে ধীরে সখ্য বাড়ে। শুরু হয় দু’জনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রেম আরও গভীর হয়। দিন-রাতের অধিকাংশ সময় তাদের মধ্যে চ্যাটিং, অডিও ও ভিডিও কলে কথা হতো।

এক পর্যায়ে যুবক সেই তরুণীর কাছে দাবি করে নগ্ন হয়ে ভিডিও কলে আসতে হবে। নারাজি তরুণীকে প্রেমের দাবি নিয়ে ভিডিও কলে আসার জন্য বাধ্য করে যুবক। তারপর চতুর যুবক ভিডিও কলে তরুণীর নগ্ন দৃশ্য কৌশলে স্ক্রিন রেকর্ডার দিয়ে রেকর্ড করে। শুধু ভিডিও নয়, বিভিন্ন সময় নগ্ন ছবি আদায় করে নেয়।পরে এসব নগ্ন ছবি ও ভিডিও তরুণীর কাছে পাঠিয়ে শুরু করে ব্ল্যাকমেইল। দাবি করে মোটা অঙ্কের টাকা।

ব্ল্যাকমেইল করা ওই যুবকের নাম মো. শাহীন আলম হৃদয়। ২৩ বছর বয়সী হৃদয় একটি কলেজে লেখাপড়া করেন। শুধু সিনথিয়া পারভীন নন। ফেসবুকে পরিচিত হয়ে অন্তত অর্ধশতাধিক তরুণীর সঙ্গে সে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। সম্পর্ক গভীর হওয়ার পর ওই তরুণীদের কাছ থেকে নগ্ন ছবি নিজের হেফাজতে এনে রাখতো। ভিডিও কলে কথা বলার সময় তরুণীদের নগ্ন হওয়ার চাপ দিতো। আর নগ্ন হলেই স্ক্রিন রেকর্ডার দিয়ে দৃশ্যগুলো রেকর্ড করে রাখতো।

টাকা দিতে অপারগতা জানালে সেই যুবক নগ্ন ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। বাধ্য হয়ে তরুণীরা তাকে কিছু টাকা দেয়। তাতে মন গলেনি তার। এভাবে বারবার টাকা চাইতে থাকে। উপায়ান্তর না পেয়ে এক তরুণী তার বাবা-মা’কে বিষয়টি জানান।

গত কয়েক বছর ধরে হৃদয় এভাবে অন্তত অর্ধশতাধিক তরুণীর গোপন ভিডিও ধারণ করে রেখেছেন। আছে অসংখ্য ছবিও। এসব ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে ওই তরুণীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এক তরুণীর অভিভাবকের করা এক মামলায় প্রতারক শাহীন আলম হৃদয়কে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অর্গানাইজড ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন টিম। ঢাকার মুগদা এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করেছে করোনাকালে কলেজ বন্ধ থাকায় তার মাথায় এই বুদ্ধি আসে। ভালো ভালো ঘরের তরুণীদের ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠাতো। তারপর শুরু করতো কথা। দশজন তরুণীকে নক করলে অন্তত দুইজন তরুণী তার সঙ্গে কথা বলতো। হৃদয় নিজেকে ধনী ঘরের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিত। কখনও কলেজ শিক্ষার্থী, কখনও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিত। আবার অনেক সময় বড় ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী বা ইউরোপের কোনো দেশে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দিত। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তরুণীদের মন জয় করে প্রেমের ফাঁদে ফেলতো।

ডিবি জানিয়েছে, সিনথিয়া পারভীনের মতো আরেক কলেজ শিক্ষার্থী সালমা বেগমের পরিচয় হয় প্রতারক হৃদয়ের সঙ্গে। দু’জনের নিয়মিত মেসেঞ্জারে কথা হতো। এভাবে এক সময় তাদেরও সম্পর্ক গভীর হয়। এক পর্যায়ে কথার জালে ফাঁসিয়ে সালমাকে বাধ্য করে তার কিছু ন্যূড ছবি ও গোসল করার মুহূর্তের ভিডিও পাঠাতে। প্রেমের ফাঁদে পড়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য সালমা তখন টের পাননি তার সর্বনাশ হতে চলেছে। 

কিছুদিন যেতে না যেতে হৃদয় টাকা দাবির পাশাপাশি কুপ্রস্তাব দিতে থাকে। তার প্রস্তাবে রাজি না হলে সেই ভিডিও ও ছবি ভাইরাল করার হুমকি দিতে থাকে। প্রস্তাবে রাজি হওয়ার জন্য নিয়মিত চাপ দেয়। ভুক্তভোগী সালমা তখন তার পরিবারকে বিষয়টি জানান। পরে তার ভাই বাদী হয়ে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে প্রতারক হৃদয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই মামলার সূত্র ধরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারের পর তার মোবাইল ফোন থেকে অসংখ্য তরুণীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক করার তথ্য পেয়েছি। মেসেঞ্জার দিয়েই তরুণীদের সঙ্গে চ্যাটিং ও ভিডিও কলে কথা বলতো। একপর্যায়ে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলে তরুণীদের ভিডিও কলের মধ্যে নগ্ন হতে বাধ্য করতো। তরুণীদের অজান্তেই স্ক্রিন রেকর্ডার দিয়ে ভিডিও রেকর্ড করে রাখতো। আবার তরুণীদের কাছ থেকে কৌশলে নগ্ন ছবি এনে রাখতো। পরে এসব নগ্ন ছবি ও ভিডিও দিয়ে তাদেরকেই ব্ল্যাকমেইল করতো। আদায় করতো লাখ লাখ টাকা।

ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ- পুলিশ কমিশনার মো. নাজমুল হক বলেনসামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে কিছু প্রতারক এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ করছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা এ ধরনের অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছি। তারপরও মানুষকে সচেতন হতে হবে। ভার্চ্যুয়াল জগতে কাউকে না জেনেশুনে তার সঙ্গে সম্পর্ক করা উচিত নয়। ব্যক্তিগত কোনো তথ্য, ছবি, ভিডিও কোনোভাবেই কারো সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না। একান্ত ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও শেয়ার বা ধারণ করা যাবে না।

কারণ ডিভাইস অন্যকারো হাতে পড়লে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হতে হবে। অনেকে মনে করে ছবি-ভিডিও ডিলেট করে দিলেই শেষ। কিন্তু ডিভাইস থেকে অনেক উপায়ে ডিলিট করা তথ্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

Exit mobile version