তরুণী রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। বাড়ি ঢাকার বাইরের একটি জেলায়। পড়ালেখার সূত্রে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাস তার। একদিন তার ফেসবুক মেসেঞ্জারে একটি বার্তা আসে। বার্তা পাঠানো ব্যক্তি নিজেকে শ্রাবণ আহমেদ নামে পরিচয় দেন। জানান, তিনি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) প্রকৌশলী। তরুণীকে তিনি আগে থেকেই চেনেন, জানেন। তার কয়েকজন সহপাঠী ও শিক্ষকের নাম বলেন, যারা তার পূর্বপরিচিত। মেয়েটি জবাব না দিলেও যুবক নিয়মিত তাকে বার্তা লিখতেন। একপর্যায়ে দু’জনের কথোপকথন শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী তরুণী কীভাবে সাগরের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন, কোন পরিস্থিতিতে নিজের গোপনীয় ছবি ও ভিডিও তাকে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিলেন, তা বিস্তারিত তুলে ধরেছেন বাংলা ম্যাগাজিনের কাছে। তিনি বলেন, ‘সে আমাকে মিষ্টি কথার ফাঁদে ফেলেছিল। মিথ্যা ভালোবাসায় জড়িয়েছিল। অতিরিক্ত কেয়ার (যত্ন) করত আমাকে। এ কারণেই তার প্রতি ভালোবাসা জন্মেছিল আমার। কিন্তু এসবই ছিল তার প্রতারণার জাল। তার ব্যবহার ও কথাবার্তায় প্রতারণার বিষয়টি একটুও বুঝতে পারিনি।’
ওই তরুণী জানান, কয়েক দিন পরই যুবক তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। নানা কৌশলে মন জয় করে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এক পর্যায়ে কথার ফাঁদে ফেলে তরুণীর ‘ব্যক্তিগত’ ছবি ও ভিডিও পাঠাতে বাধ্য করেন। পরে সেসব ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেট ও স্বজনের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ধর্ষণ করেন।
শ্রাবণ আহমেদ তার আসল নাম নয়। তরুণীদের সঙ্গে প্রতারণার জাল বিছাতে একেক সময় একেক নাম ব্যবহার করতেন তিনি। যুবকের আসল নাম সাইফুল ইসলাম সাগর। বিটিআরসিতে তিনি চাকরি করার কথাও মিথ্যা বলেছিলেন। এখন পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় কারাগারে রয়েছেন।
তরুণীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে ফেসবুকের মাধ্যমে সাগরের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তখন নিজের নাম বলেছিলেন শ্রাবণ আহমেদ। পরিচয়ের তিন-চার দিন পর সাগর তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। বাড়িতে তার বাবা-মা ও মামাকে পাঠাবেন বলে জানান। পরিচয়ের প্রথম দিকেই সাধারণত কোনো যুবক প্রেমের প্রস্তাব দেন; কিন্তু সাগর বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ায় তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তরুণী। এরই মধ্যে চলতে থাকে কথোপকথন।
সাত-আট দিন পর তরুণীকে সাগর জানান, তার স্বজনরা পরিবারের কারও সঙ্গে কথা বলতে চান বিয়ের বিষয়ে। তরুণী তার চাচার ফোন নম্বর দেন তাকে। সাগর নিজেই মামা সেজে তরুণীর চাচাকে ফোনে বলেন, ‘তার ভাগ্নে তরুণীকে পছন্দ করেন। বিয়ে করতে চান তারা। তাই পারিবারিকভাবে বিষয়টি নিয়ে বসা দরকার।’
এর কয়েক দিন পর সাগর তরুণীর ‘ব্যক্তিগত’ ছবি ও ভিডিও ইমোতে পাঠাতে বলেন। এ ধরনের ছবি দিতে রাজি না হলে সাগর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন তোলেন। বলেন, ‘আর ক’দিন পর তুমি আমার স্ত্রী হচ্ছো। ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও দিতে সমস্যা কোথায়। তুমি তো আমারই, নাকি। আমাকে বিশ্বাস হয় না? আমি কী খারাপ ছেলে’ ইত্যাদি। এক পর্যায়ে নিজের ছবি ও ভিডিও করে তাকে পাঠান ওই তরুণী।
তরুণী বলেন, বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাড়িতে স্বজনদের পাঠানোর পাঁচ-ছয়টি তারিখ পরিবর্তন করেন সাগর। কখনও বলা হতো নানা অসুস্থ, কোমায় আছে। কখনও বলা হতো তার নানা মারা গেছে। কখনও বলা হতো, তার মা প্রচণ্ড অসুস্থ। যে কারণে বিয়ের বিষয়ে কথা বলতে যেতে পারছে না। এর পরই সন্দেহ হয়। খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করি সাগরের বিষয়ে।
বিটিআরসিতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, শ্রাবণ নামে কেউ সেখানে চাকরি করেন না। এ বিষয়ে ফোনে জানালে সাগর তাকে বলেন, নাম ধরে সরকারি ওই প্রতিষ্ঠানে খুঁজে পাওয়া যায় না। একটি কোড নম্বর আছে তার। ওই কোড নম্বর নিয়েও তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি বিটিআরসিতে। সন্দেহ আরও বাড়ে।
তরুণী জানান, তার বিশ্বাস অর্জনের জন্য একাধিকবার সাগর তার মা ও মামার সঙ্গে তাকে ফোনে কথা বলতে দিতে চেয়েছিলেন। একদিন রাতে তরুণীকে ফোন করে সাগর বলেন, তার মা কথা বলতে চান। তরুণী কথা বলতে আগ্রহ দেখালে জানানো হয়- তার মা টয়লেটে। আজ থাক, অন্যদিন। এভাবে নানা ধরনের অজুহাত সামনে এনে কথা বলার সুযোগ দেননি তিনি।
তিনি বলেন, এক সময় সাগর তাকে বলেছিলেন, তার নানাবাড়ি নরসিংদী, একটি স্কুলের পাশে। ওই স্কুলের ছবি গুগলে দেখা যায়। মেয়েটি গুগল ম্যাপে সাগরের বলা স্কুলের নাম পাননি। ফোন করেন সাগরকে। এক পর্যায়ে সাগর তার আসল চেহারায় বেরিয়ে আসেন। তার নাম শ্রাবণ নয় বলে স্বীকার করেন। হুমকি দিয়ে বলেন, তাকে নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে ‘ব্যক্তিগত’ ছবি ও ভিডিওগুলো পর্নোসাইটে আপলোড এবং স্বজনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তার কথা মতো চলতে হবে। এর পরই মেয়েটিকে ঢাকার বিমানবন্দর এলাকায় যেতে বলেন। তিনি সেখানে যেতে বাধ্য হন। সাগর তাকে প্রাইভেটকারে করে গাজীপুরের একটি রিসোর্টে যান। সেখানে তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়।
ঢাকায় ফিরে যুবকের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে তার পরিচিত কয়েকজনের কাছে ছবি ও ভিডিও পাঠিয়ে দেন সাগর। তরুণী জানান, তিনি পরে জানতে পারেন, তার মতো একাধিক মেয়ে সাগরের শিকার হয়েছেন। তার সঙ্গে প্রতারণার পর সাগর ২০১৯ সালে দেশের বাইরে চলে যান।
রাজধানীর মিরপুর থানায় এক চিকিৎসক তরুণীর দায়ের করা পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় গত ২৮ জুন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে গ্রেপ্তার হন সাগর। ওই দিন তিনি কাতার থেকে দেশে ফেরেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার পরই গ্রেপ্তার হন তিনি। বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। সাগরের গ্রেপ্তারের খবর শুনে এরই মধ্যে কুমিল্লা জেলার একটি থানায় এই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী তার বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেছেন।