বাবা-মায়ের পছন্দেই সেই লিমনের বিয়ে কাল
র্যাবের গুলিতে পা হারানো সেই লিমন সংসারজীবন শুরু করতে যাচ্ছেন। কনে যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওপাড়া এলাকার রাবেয়া বসরি। কনের বাড়িতেই শুক্রবার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছে। ১০ বছর আগে র্যাবের গুলিতে পা হারিয়েছিলেন লিমন হোসেন। তখন বয়স ছিল ১৬। এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার সময় লিমনের পা হারানোর ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। প্রশ্নের মুখে পড়ে র্যাবের অভিযান।
ঝালকাঠির সাতুরিয়া গ্রামের সেই কিশোর এখন সাভার গণবিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের প্রভাষক ও শিক্ষানবীশ আইনজীবী। বিয়ে করে সংসারজীবন শুরু করতে যাচ্ছেন তিনি।লিমন বলেন, বাবা-মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে জীবনে আরেক অধ্যায় শুরু করছি। বৃহস্পতিবার নিজ বাড়িতে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান হয়েছে। হবু স্ত্রী রাবেয়া বসরি বলেন, সে (লিমন) নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্যারিয়ার গড়েছে, দাম্পত্য জীবনেও দায়িত্বশীল হবেন বুঝেই বিয়েতে রাজি হয়েছি।
লিমন হোসেন বলেন, `র্যাব আমাকে যখন গুলি করেছে, তখনও আমি জানি না কেন তারা আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিল। পরে শুনেছি তারা অন্য একজনকে ভেবে ভুলে আমার পায়ে গুলি করেছে।ডাক্তাররা আমার একটি পা যেদিন কেটে ফেলেছে, সেদিন থেকেই আমি হাল ছাড়িনি। কখনো ভাবিনি আমি পঙ্গু।’
অদম্য শক্তির লিমন এরপর চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা, গড়েছেন ক্যারিয়ার। তিনি বলেন, ‘সব সময় গরিব বাবা-মাকে সাহস দিয়েছি, মানুষের সহযোগিতায় পড়াশুনা করেছি। আজ আমি স্বাবলম্বী, আমার এই জীবনযুদ্ধের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান মানবাধিকার সংগঠন এবং মিডিয়া অঙ্গনের। আমি মানবাধিকারকর্মী এবং মিডিয়াকর্মীদের প্রতি চিরঋণী।’
২০১১ সালের ২৩ মার্চ বিকেলে ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া ইউনিয়নে বাড়ির পাশের একটি বাগানে নিয়ে লিমনের পায়ে গুলি করেন র্যাব সদস্যরা। এরপর লিমনসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা ও অস্ত্র রাখার অভিযোগে দুটি মামলা করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন লিমনের গুলিবিদ্ধ পা কেটে ফেলতে হয় ঘটনার তিন দিন পর।
সে বছরই লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম ঝালকাঠি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে র্যাবের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১১ সালের ২৩ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মাঠে মায়ের সঙ্গে গরু আনতে গিয়েছিলেন লিমন হোসেন। এ সময় তিনটি মোটরসাইকেলে ছয়জন র্যাব সদস্য সেখানে উপস্থিত হন। পরে লুৎফর রহমান নামে এক র্যাব সদস্য লিমনের শার্টের কলার ধরে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেন। তখন লিমন তার পা ধরে কেঁদে বলেন, ‘আমি সন্ত্রাসী না, আমি স্টুডেন্ট। পাশের ইটভাটায় আমি কাজ করি। খেয়া পার হয়ে স্কুলে যাই।’
র্যাবের মামলা চলার সময় ঝালকাঠির কারা হাসপাতালে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান লিমন। জামিনে মুক্ত হয়ে ২০১৩ সালে পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার কাঠালিয়া পিজিএস বহুমুখী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। পরের বছর মামলা দুটি থেকে লিমনকে বাদ দেয়া হয়।
সাভার গণবিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন লিমন। এরপর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম ডিগ্রি অর্জন করে ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সাভার গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে শিক্ষা সহকারী পদে যোগ দেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সহকারী প্রভাষক হিসেবে পদোন্নতি হয় লিমনের।
লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বলেন, ‘গত ১০ বছরে যত কষ্ট হরছি সব কষ্ট শ্যাষ হইয়া গেছে আইজ পোলার বিয়ায়। কোনো দিন ভাবি নাই মোর পোলা লিমন কলেজের মাস্টার অইবে। বৌডার লইগ্যা আমনেরাও দোয়া হইররেন। ওরা যেন সুখী অইতে পারে।’