ভয়ঙ্কর ফাঁদে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড
একটি প্রতারক চক্র ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অসাধু কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে জাল সনদ তৈরি করে আসছে। তারা টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের আসল সনদের তথ্য মুছে দিয়ে নতুন তথ্য যুক্ত করে জাল সনদ তৈরি করছে। আসল শিক্ষার্থীদের অজান্তে রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়া নিজের নাম, বাবা-মায়ের নাম এমনকি জন্ম তারিখের তথ্য পরিবর্তন করে দিচ্ছে। এতে করে আসল শিক্ষার্থীর কাছে থাকা সনদ মূল্যহীন হয়ে পড়ছে।
ধানমণ্ডির কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুর তাবাসসুম সুলতানা। এই শিক্ষার্থী ২০১৬ সালে ওই স্কুল থেকে জেএসসি ও ২০১৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পাস করে। পরবর্তীতে একটি কলেজেও ভর্তি হয়। চলতি মাসের ২১ তারিখ তার মোবাইলে এইচএসসির ফরম ফিলাপের টাকা জমা দেয়ার তাগাদার একটি মেসেজ আসে। মেসেজটি খুলে তাবাসসুম রীতিমতো অবাক। কারণ তার একাডেমিক ব্যক্তিগত তথ্য পুরো ওলটপালট। রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়া তার নিজের নাম, বাবা-মায়ের নাম ও জন্মতারিখ তার অজান্তেই পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু কেন, কীভাবে বা কে তার এসব তথ্য পরিবর্তন করলো সেটি তাবাসসুম ও তার পরিবার আঁচ করতে পারেনি।
সংশ্লিষ্ট স্কুল-কলেজে যোগাযোগ করে তারা এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেননি। পরে তারা শিক্ষা বোর্ডে গিয়ে দেখেন এসএসসির পাশাপাশি জেএসসির সার্টিফিকেটেরও তথ্য পরিবর্তন হয়ে গেছে। পরে তাবাসসুমের পরিবার ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা করে। মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ পায় চাঞ্চল্যকর তথ্য।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এ ঘটনায় ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছেন।
ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট টিম ওই ঘটনায় মোট ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা একই চক্রে কাজ করে। শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর, রমনা ও চকবাজার এলাকা থেকে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মো. মারুফ ঢাকা বোর্ডের কর্মচারী। মোস্তফা কামাল চক্রের মূল হোতা।
নূর রিমতি হচ্ছে জাল সনদের আবেদনকারী। যার জন্য তাবাসসুমের সনদের তথ্য মুছে ফেলা হয়। আর জামাল হোসেন নূর রিমতির মামা। এই মামার মাধ্যমে রিমতি চক্রের মূল হোতা মোস্তফা কামালের সন্ধান পায়। ফারুক আহম্মেদ স্বপন, মাহির আলমা ও আবেদ আলী চক্রের সহযোগী। তারা জাল সার্টিফিকেট তৈরি করতে আগ্রহী এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে চুক্তি করে। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ এডমিট কার্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের নাম ও অনলাইন রেজাল্ট শিটের কপি জব্দ করা হয়েছে।
জাল সার্টিফিকেট তৈরি করতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তিরা প্রথমে চক্রের মূল হোতা মোস্তফা কামাল বা তার সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কারণ চক্রের সদস্যরা দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পরে তারা জাল সার্টিফিকেট তৈরির জন্য কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ওই ব্যক্তির কাছ থেকে সংগ্রহ করে কামালকে দেয়। এরপর কামাল সার্টিফিকেট তৈরি করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির নাম মিলানোর জন্য শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটে রেজাল্ট দেখার অপশনে গিয়ে সার্চ করে। এভাবে ওই নামের কাছাকাছি একটি নাম খুঁজে বের করে। পরে ওই নামের ব্যক্তির নিজের নাম, পিতা-মাতার নাম পরিবর্তনের আবেদন শিক্ষা বোর্ডের অনলাইনে জমা দেয়া হয়। আবেদনের সঙ্গে সাপোর্টিং ডকুমেন্ট হিসাবে প্রার্থীর যেসব কাগজপত্র জমা দেয়া হয় সেগুলোও জাল তৈরি করে প্রতারকরা। এমনকি আবেদনের সঙ্গে প্রার্থীর যে ছবি দেয়া হয় সেটিও অন্য মানুষের।
ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেপ্তার নূর রিমতি বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেনি। তার ইতালি যাওয়ার জন্য এইচএসসি পাসের সনদ প্রয়োজন হয়। তাই এ সনদের জন্য সে একটি কলেজে ভর্তি হতে চায়। এজন্য তার দরকার হয় এসএসসি সনদ। এজন্য এসএসসির জাল সনদ তৈরির জন্য সে তার মামা গ্রেপ্তার জামাল হোসেনের মাধ্যমে মোস্তফা কামালের সঙ্গে তিন লাখ টাকার চুক্তি করে।
চুক্তি অনুযায়ী কামাল শিক্ষা বোর্ডের দালাল মারুফের সঙ্গে সমন্বয় করে নূর রিমতির নামের কাছাকাছি মিল করে নূর তাবাসসুমের সার্টিফিকেট সংক্রান্ত জেএসসি ও এসএসসি পাসের সকল তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর তারা প্রথমে শিক্ষার্থীর বাবার নাম, মায়ের নাম সংশোধনের জন্য শিক্ষা বোর্ডের নির্ধারিত ফরমেটে আবেদন করে। আবেদনের সঙ্গে যেসকল কাগজপত্র দেয়া হয়েছে সেগুলো ছিল জাল। এরপর শিক্ষা বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টাকার বিনিময়ে বোর্ডের ওয়েবসাইটের রেজাল্ট আর্কাইভে নির্ধারিত ফরমেটে সংরক্ষিত কৃতকার্য প্রকৃত শিক্ষার্থী নূর তাবাসসুমের তথ্য পরিবর্তন করে অকৃতকার্য শিক্ষার্থী নূর রিমতির তথ্যসমূহ আপলোডের মাধ্যমে জাল সনদ তৈরি করে।
কই প্রক্রিয়ায় জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে নেয়। পরিবর্তিত এসব তথ্য শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইটেও দেখায়। তিনি বলেন, এই প্রতারক চক্র ঢাকা শিক্ষা বোর্ডসহ অন্যান্য শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নাম, বাবার নাম, মায়ের নাম, জন্ম তারিখসহ অন্যান্য তথ্য পরিবর্তন করে অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের তথ্য সংযোজন করে জাল সনদ তৈরির মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেয়।
আবেদনের পরে কামাল শিক্ষা বোর্ডে থাকা তার এজেন্টের মাধ্যমে নাম পরিবর্তনের বোর্ডে আবেদনটি অনুমোদনের জন্য বোর্ড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কামাল ও বোর্ডের এজেন্ট নাম পরিবর্তনের জন্য বোর্ডের সচিবকে ম্যানেজ করে। তারপর সচিবের নির্দেশে বোর্ডের উপ-সচিবকে ম্যানেজ করে আবেদনের আইডি সংগ্রহ করে। সচিব ও উপ-সচিবকে ম্যানেজ করার পর আবেদনটি বোর্ডে অনুমোদন দেয়া হয়। বোর্ড অনুমোদন দেয়ার পর জাল সার্টিফিকেট প্রার্থীর তথ্য বোর্ডের ওয়েবসাইটে প্রদর্শন হয়। এরপর আবেদনকারী তার চাহিদা অনুযায়ী নামের সার্টিফিকেট ও এডমিট কার্ড সংগ্রহ করতে পারে। এভাবে তারা দীর্ঘদিন ধরে অসংখ্য সনদ জালিয়াতি করেছে।
কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সচিব তপন কুমার সরকার ও উপ-সচিব (বৃত্তি) মীর আশরাফ আলী ২০২০ সালের ২৯শে অক্টোবর নূর তাবাসসুম সুলতানার আবেদনের প্রেক্ষিতে সংশোধনের অনুমোদনের চিঠিতে স্বাক্ষর করেন। অভিযোগ আছে প্রতারক চক্র এই কর্মকর্তাদের অধীনস্তদের দিয়ে তাদেরকে টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে স্বাক্ষর করিয়েছেন। ডিবির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া চক্রের সদস্যরাও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, টাকার বিনিময়ে ওই কর্মকর্তাদের দিয়ে স্বাক্ষর করানো হয়েছে।
ভুক্তভোগী নূর তাবাসসুম সুলতানার মা রোকেয়া সুলতানা মানবজমিনকে বলেন, মেয়ের সনদে তার নাম, পিতার নাম ও আমার নাম পরিবর্তন হয়েছে সেটি আমরা জানতাম না। তার এইচএসির ফরম ফিলাপের টাকা জমা দেয়ার একটি মেসেজ তার মোবাইলে আসার পর জানতে পেরেছি। এরপর তার স্কুলে যোগাযোগ করলে তারা বোর্ডে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বোর্ডে গিয়ে জানতে পারি তার জেএসসি ও এসএসসির রোল ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ছাড়া ব্যক্তিগত সব তথ্য পরিবর্তিত হয়েছে। পরে আমরা মামলা করি।
ডিবি সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার আশরাফউল্লাহ বলেন, প্রায় ১০ বছর ধরে চক্রটি বোর্ডের কিছু অসাধু কর্মচারী-কর্মকর্তাদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে আসল সনদ নকল করছিল। শুধু জাল সনদ নয় তারা রেজাল্ট পরিবর্তন, জিপিএ বাড়িয়ে দেয়াসহ আরও নানা অবৈধ কর্মকাণ্ড করতো।