কোভিড মহামারির কারণে বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লাখ শিশু সশরীরে তাদের শিক্ষা গ্রহণ শুরু করতে পারছে না। বিশ্বজুড়ে এ সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি। ইউনিসেফের এক বিশ্লেষণে এমন কথাই বলা হয়েছে। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই বিশাল সংখ্যক শিশুরা সশরীরে শিক্ষা গ্রহণের প্রথম দিনটির জন্য এক বছরের বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করে আছে। কবে নাগাদ তারা স্কুলে যেতে পারবে তা নিয়েও রয়েছে ব্যাপক অনিশ্চয়তা।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, স্কুলের প্রথম দিন একটি শিশুর জীবনে উল্লেখযোগ্য এক মুহূর্ত। এদিন তাদেরকে ব্যক্তিগত শিক্ষা অর্জন এবং বিকাশের ক্ষেত্রে একটি জীবন পরিবর্তনকারী পথে পরিচালিত করে। আমরা বেশিরভাগই স্কুলের প্রথম দিনের অসংখ্য ছোটখাটো বিবরণ মনে রাখি। যেমন, কী পোশাক পরেছিলাম, শিক্ষকের নাম, কার পাশে বসেছিলাম ইত্যাদি। তবে লাখ লাখ শিশুর জন্য সেই গুরুত্বপূর্ণ দিনটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে। কোভিড-১৯ এর কারণে স্কুল বন্ধের ক্ষেত্রে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম এটি। যখন বিশ্বের অনেক জায়গায় ক্লাস পুনরায় শুরু হয়েছে, তখন প্রথম শ্রেণির লাখ লাখ শিক্ষার্থী এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সশরীরে ক্লাসরুমে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রথম শ্রেণিতে পড়া, লেখা ও গণিতের সঙ্গে শিশুদের পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এটি ভবিষ্যতের সব ধরনের শিক্ষার ভিত্তি গড়ে দেয়। একইসঙ্গে এটি এমন একটি সময় যখন সশরীরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষা গ্রহণ শিশুদের স্বাধীনস্বত্বার বিকাশ, নতুন নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নেয়া এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে। সশরীরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষাগ্রহণ একইসঙ্গে কোন শিশুর শিক্ষার ক্ষেত্রে ঘাটতি, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং নির্যাতনের বিষয়গুলো শনাক্ত ও সমাধান করতে শিক্ষকদের সহায়তা করে।
স্কুলে যেতে না পারায় শিশুদের সামগ্রিক কল্যাণ নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী স্কুলগুলো গড়ে ৭৯ শিক্ষা-দিবস পুরোপুরি বন্ধ ছিল। তবে ১৬ কোটি ৮০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য স্কুলগুলো একটানা পুরো বছরই বন্ধ থাকে। স্কুল বন্ধ থাকার কারণে অনেক শিশুদের শিক্ষা জীবনের বড় ক্ষতি হচ্ছে। তারা মানসিক চাপে পরছে। এছাড়া ঝরে পড়া, শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহের ঝুঁকিও বাড়ছে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন, স্কুল এবং সশরীরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষাগ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ থাকা শিশুদের কেবল পড়াশোনার ক্ষেত্রে নয়, একইসঙ্গে তাদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা এবং মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার উপর অত্যন্ত গুরুতর প্রভাব ফেলে। প্রান্তিক শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তাদেরকে অধিকতর দারিদ্র্য এবং অসমতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নিরাপদে স্কুল পুনরায় খুলে দেয়া এবং সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিনিয়োগ করাকে অগ্রাধিকার দেয়া আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বব্যাপী দেশগুলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। তবে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে ২৯ শতাংশের কাছে এই পদ্ধতি পৌঁছানো যাচ্ছে না। এ পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদানের জন্য সম্পদ বা উপকরণের ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশে মহামারির পুরোটা সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার স্তর পর্যন্ত ৪ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, স্কুলের ইতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলো শিশুদের ভবিষ্যতের সামাজিক, আবেগীয় ও শিক্ষাগত দিক গঠন করে। যেসব শিশু শুরুর বছরগুলোতে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ে তারা প্রায় ক্ষেত্রেই স্কুলে কাটানো অবশিষ্ট সময়ের জন্য পিছিয়ে থাকে এবং বছরের পর বছর এই ব্যবধান বাড়তে থাকে। আবার শিশুর প্রাপ্ত শিক্ষা-বছরের সংখ্যা তার ভবিষ্যতের আয়ের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
ইউনিসেফের প্রতিবেদে বলা হয়, নিরাপদে স্কুল খোলার লক্ষে ইউনিসেফ বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। এর অংশ হিসাবে নির্দেশিকা তৈরি করা হচ্ছে। এতে শিশু ও শিক্ষকদের মাস্ক ও হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ইউনিসেফ শিশু, তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকদের সাথেও যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে যাতে নিরাপদে স্কুল খুলে দেয়ার বিষয়ে সবার মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়।