অপরাধএক্সক্লুসিভবাংলাদেশ

বিকেলে পিয়ন হয়ে যায় সচিব

কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীঘেরা দেশের প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে কখনো উপসচিবের কক্ষে, কখনো যুগ্ম সচিবের কক্ষে কর্মকর্তাদের চেয়ারে বসে চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। পরে ভুয়া নিয়োগ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রতারকচক্রের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে অপরাধ তদন্ত বিভাগও (সিআইডি)।দীর্ঘ ১৮ মাস তদন্ত শেষে দাখিল করা এ চার্জশিটে বিকালের সেই ‘সচিব’দের বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে প্রতারণার আদ্যোপান্ত; উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

এই চক্রের অন্যতম তিন সদস্যের (রাজধানীর মিরপুর থানায় করা একটি মামলার তিন আসামি) বিরুদ্ধে সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছেন মামলার তৃতীয় তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির ঢাকা মেট্রো পশ্চিমের উপপুলিশ পরিদর্শক মো. সাখাওয়াত হোসেন। চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- সচিবালয়ে কর্মরত (বর্তমানে বরখাস্ত) চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী মো. শফিকুল ইসলাম (ফরাশ শাখা- সকালেঅফিসের তালা খোলা এবং বিকালে তালাবদ্ধ করার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারী), সচিবালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (অস্থায়ী-এমএলএসএস) কেএম মর্তুজা আলী রনি এবং তাদের সহযোগী দালাল মো. শাহিনুল কাদির সুমন ওরফে পালসার সুমন।

রহস্যজনক কারণে চার্জশিটের মাধ্যমে চক্রের পালের গোদা কেএম মর্তুজা আলী রনির নাম-ঠিকানা সঠিক পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে মামলার দায় থেকে তার অব্যাহতি চাওয়ায় প্রশ্ন তুলেছেন খোদ বাদী। একেএম মোসলেহ উদ্দিন নামে প্রতারণার শিকার ওই ব্যক্তি (বাদী) গতকাল সোমবার বলেন, কেএম মর্তুজা আলী রনি চাকরিদাতা এই প্রতারকচক্রের মূলহোতা। কিন্তু চার্জশিটে রনির নাম-ঠিকানা না পাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে মামলা থেকে তার দায়মুক্তি চাওয়ায় তদন্তসংশ্লিষ্টদের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ধারণা করছি, অনৈতিক কোনো সুবিধা নিয়ে কাজটি করা হয়েছে। কারণ, রনির পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র (ভোটার আইডি কার্ড) বর্তমান ও সাবেক ঠিকানা তদন্তসংশ্লিষ্টদের হাতে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া রনি প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও তদন্তসংশ্লিষ্টরা তাকে খুঁজে পাচ্ছেন না- এটা মেনে নেওয়া যায় না। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ প্রতারকচক্রের সবাইকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন মোসলেহ উদ্দিন।

অফিসের সময় শেষ হয়ে গেলে যখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সচিবালয় ছাড়েন, তখন তাদেরই কক্ষে শুরু হয় প্রতারকদের ‘অফিস’! পোশাক-পরিচ্ছদ পরিবর্তন করে এসব প্রতারকের কেউ বনে যান সচিব-উপসচিব; কেউবা তাদের পিএ। কখনো উপসচিবের কক্ষে, কখনো যুগ্ম সচিবের কক্ষে- কর্মকর্তাদের চেয়ারে বসেই প্রতারকরা চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়ার নামে নাটক করে বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেওয়ার নামে হাতিয়ে নিয়েছেন মাথাপিছু ১০ লাখ থেকে ১৮ লাখ টাকা পর্যন্তও।

বছরের পর বছর ধরে এ ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে সংঘবদ্ধ এ প্রতারকচক্রের সদস্যরা চাতুর্যের সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন দপ্তরের প্যাডে সংশ্লিষ্ট উপসচিবের স্বাক্ষর জাল করে প্রকৃত নিয়োগপত্রের মতো হুবহু অথচ ভুয়া নিয়োগপত্র তুলে দিয়েছেন চাকরিপ্রত্যাশীদের হাতে। স্মারক নম্বরে বসিয়ে দিয়েছে ‘অফিস আদেশ’। চাকরির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ‘একমাত্র রাষ্ট্রীয় কার্যে ব্যবহার্য’ লেখা সরকারি খামে সচিবের নামে তারা ভুয়া সেই নিয়োগপত্র দিয়েছেন ভুক্তভোগীদের। শুধু তাই নয়, মোটা টাকা গ্রহণ করার পর মাসের পর মাস ঘুরেও যখন চাকরিপ্রত্যাশীরা দপ্তর বুঝে পাননি, তখন গা বাঁচাতে তাদের হাতে ট্রেনিং পিরিয়ডের নামে দু-এক মাসের বেতনও তুলে দেওয়া হয়।

 ২০১৯ সালের ৩ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর মডেল থানায় মামলা (নম্বর- ১৩) করেন একেএম মোসলেহ উদ্দিন নামে প্রতারণার শিকার ওই ভুক্তভোগী। মামলায় আসামি করা হয় সচিবালয়ে কর্মরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ফরাশ শাখার শফিকুল ইসলাম, কেএম মর্তুজা আলী রনি ও মো. শাহিনুল কাদির সুমন ওরফে পালসার সুমনকে। প্রতিবেদনটি যেদিন প্রকাশ হয়, সেদিনই কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ফরাশ শফিকুল ইসলামকে। র‌্যাব ৪-এর হাতে গ্রেপ্তার হয় চক্রের সদস্য পালসার সুমন। আর প্রতারকচক্রের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট শনাক্তে তদন্ত কমিটি গঠন করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের বাংলাদেশ সচিবালয়ের পিডব্লিউডি ডিভিশন। এদিকে থানাপুলিশে হওয়া মামলাটির তদন্তভার হস্তান্তর করা হয় সিআইডিতে।মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এসআই মো. সাখাওয়াত হোসেনের মোবাইল ফোনে গতকাল একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ওপাশ থেকে সাড়া না দেওয়ায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, শাহিনুল কাদির সুমন, কেএম মর্তুজা আলী রনি ও শফিকুল ইসলাম পরস্পর যোগসাজশে বাদীর বোন ও শরিফুল ইসলামকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চাকরি দেওয়ার নাম করে তাদের ভুয়া সচিব পরিচয়ে মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করে বিশ্বাস অর্জন করা ছাড়াও বাদীর কাছ থেকে ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ছাড়াও তাদের ভুয়া অফিস অর্ডার ও নিয়োগপত্র দিয়ে কালক্ষেপণের সুযোগে ওই প্রতারকরা বাদীর টাকাগুলো আত্মসাৎ করে। আসামি কেএম মর্তুজা আলী রনির নাম-ঠিকানা সঠিক পাওয়া যায়নি বিধায় তাকে এই মামলার দায় হতে অব্যাহতিদানের প্রার্থনা করে এজাহারনামীয় আসামি শাহিনুল কাদির সুমন ও শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র (মিরপুর মডেল থানার অভিযোগপত্র নং ১৬) দাখিল করেন উপপুলিশ পরিদর্শক সাখাওয়াত হোসেন।

Back to top button