পিয়াসা থাকেন লাখ টাকার ফ্ল্যাটে চড়েন কোটি টাকার গাড়িতে।কে এই পিয়াসা? কিভাবে তার উত্থান? তার বেপরোয়া জীবনের রহস্যই বা কি? চট্টগ্রামের একটি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে আসা একটা মেয়ে ঢাকা শহরে কেমন করে এমন লাক্সারিয়াস জীবনযাপন করে আসছিলেন? তার বারিধারার ফ্ল্যাটে কার কার যাতায়াত ছিল? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর মিলছে না।পিয়াসার বাসার ফ্ল্যাটের গ্যারেজে গিয়ে দেখা মেলে দুটি বিলাসবহুল গাড়ির। একটি বিএমডব্লিউ এস-২০৯ মডেলের সিলভার রঙের অপরটি মাজদা এক্সেলা ব্রান্ডের নীল রঙের গাড়ি।বৈধ কোনও আয় না থাকলেও এসব দামী গাড়ি পিয়াসার নিত্য সঙ্গী।
চট্টগ্রামের মেয়ে বিতর্কিত মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসা।মডেলিংয়ের আড়ালে অপরাধ সাম্রাজ্যে বিচরণ তার। আন্ডারওয়ার্ল্ড কানেকশনে অস্ত্র কারবার থেকে শুরু করে মাদকের জমজমাট বাণিজ্যের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের নিজের মাদকের আসরে ডেকে গোপন ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করত সে। তার আসরে যাতায়াত করতেন দেশের বেশ কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। এমন তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ।অভিযোগ আছে, দিনে ঘুমান আর রাতে রাণী হন নানা বিত্তবানের। রাত হলে বিলাশ বহুল বিএমডব্লিউটি মার্সিডিজ ব্রান্ডের গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে চলতেন রাজধানীর বার ও নাইট ক্লাবের উদ্দেশে। অনেকটা খোলামেলা পোষাকে ঢুকে পড়তেন সেখানে। প্রভাবশালী আর ধনীর দুলালদের সঙ্গে চলতো ডিসকো ড্যান্স। গ্রুপ বেধে সেবন করতো মাদক। পরে চলে যেতো রাজকীয় ফ্ল্যাটে।
পিয়াসার সঙ্গে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও এখন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। আর মরিয়ম আক্তার মৌ ছিল তার সাম্রাজ্যের অন্যতম সহযোগী। অপরাধ সাম্রাজ্যের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে মডেল পিয়াসা ও মৌকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পৃথক মাদক মামলায় তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।এসব ভিডিওতে দেশের অনেক প্রভাবশালীর উপস্থিতি থাকায় রীতিমতো বিব্রতবোধ করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। বলছেন, ভিডিওগুলো প্রকৃতপক্ষেই আসল কিনা তা যাচাই-বাছাই করার প্রয়োজন রয়েছে। এসব ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলারও প্রয়োজন। অন্যদিকে, গরু আমদানির নামে মাদক চোরাচালান ব্যবসায় পিয়াসার সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এসেছে।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর ৩০০ ফিট এলাকায় গ্রেফতার পিয়াসা তার ‘ডেইরি সান’ নামের গরুর ফার্মের ব্যানারে মায়ানমার থেকে গরু আমদানি করতেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব গরুর পেটে ইয়াবার চালান আনতেন তিনি। সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গেও পিয়াসা সম্পৃক্ত ছিলেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ বাংলা ম্যাগাজিনকে বলেন, পিয়াসার মাদক বাণিজ্যের বড় নেটওয়ার্ক রয়েছে। ওই নেটওয়ার্কে কারা জড়িত সে সম্পর্কে জানতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এছাড়া পিয়াসার মাধ্যমে যারা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন তারা অভিযোগ নিয়ে এলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পিয়াসার আসরে নামিদামি লোকজনের যাতায়াত থাকার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
কাস্টমস বিভাগের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর মেয়ে পিয়াসার লেখাপড়া মাত্র উচ্চমাধ্যমিক। অল্প শিক্ষিত হয়েও একটি টেলিভিশন চ্যানেলের ঊর্ধ্বতন পদ বাগিয়ে নেন তিনি। চ্যানেলটির দুই শতাংশ শেয়ারও কব্জায় নিয়েছিলেন পিয়াসা। যদিও অল্প দিনে পিয়াসা বিভিন্ন পেশার অনেককে ব্ল্যাকমেল করার অভিযোগ ওঠায় তাকে সেই পদ থেকে বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ। পরে চ্যানেলটিতে তার দুই শতাংশ শেয়ারও হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হয় পিয়াসাকে।
রবিবার রাতে পিয়াসার দেওয়া তথ্যে গ্রেফতার হয় আরেক মডেল মৌ আক্তার। মোহাম্মদপুরে পাঁচতলা আলিশান বাড়ি রয়েছে তার। নেক্সাস, পাজেরো ও টয়োটা ব্র্যান্ডের তিনটি দামি গাড়ি চালাতেন মৌ। অথচ তার দৃশ্যমান আয়ের উৎস নেই। মৌ মডেলিং পেশার আড়ালে ব্ল্যাকমেলিং করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতেন বলে অভিযোগ পেয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। মাদক ও অনৈতিক ব্যবসায় তার সংশ্লিষ্টতার কিছু প্রমাণ ইতিমধ্যে গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে। তাকে গ্রেফতারের পর অনেক ভুক্তভোগীই পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে জানা গেছে।
মাদক মামলায় গ্রেফতারের পর মডেল মৌ-এর সঙ্গে ভিআইপিদের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। একই সঙ্গে অঢেল সম্পদের উৎস খুঁজে দেখছেন তারা। এরই মধ্যে তার বাসা থেকে জব্দ করা হয়েছে সিসিটিভি ফুটেজ। ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মৌ ১১টি বিয়ে করেছেন। তার সর্বশেষ স্বামী একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। ধনাঢ্যদের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেছিলেন। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার পর আরেকজনের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসতেন। সাবেক স্বামীরা মৌ-এর অপকর্ম সম্পর্কে সবই জানতেন। তার কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে অনেক সময় নিজেরাই তাকে তালাক দিতেন।
ডিবি পুলিশের কাছে তথ্য আছে, মৌ-এর নিয়ন্ত্রণে অর্ধশত সুন্দরী তরুণী রয়েছেন। এসব তরুণীদের দিয়ে তিনি অর্থশালীদের টার্গেট করতেন। কৌশলে তাদের বাসায় নিয়ে আসতেন। মদ খাইয়ে অচেতন করে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি কিংবা ভিডিও ধারণ করতেন। পরে ওই ব্যক্তি যদি কথামতো কাজ না করতেন, তাহলে ভয় দেখানোর পাশাপাশি ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিতেন। এভাবে অনেকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আর দরিদ্র পরিবারের সুন্দরী তরুণী, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রীরা মৌ-এর প্রতারণা চক্রের সদস্য। তারা দিনের বেলা লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে রাতে সক্রিয় হতেন। তার বাসায় গভীর রাত পর্যন্ত মাদক সেবনের পাশাপাশি চলত অসামাজিক কার্যকলাপ। ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইমের এক কর্মকর্তা জানান, তিন দিনের রিমান্ডের প্রথম দিন গতকাল মৌকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার এত সম্পদের উৎস কোথা থেকে, কী কারণে তার আগের সব সংসার ভেঙে গেছে এবং সব বিয়েতেই মোটা অঙ্কের কাবিন ছিল তার। বিয়ের ফাঁদ পেতে প্রতারণা করতেন কি না- এমন নানা বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। কত দিন ধরে এবং এ পর্যন্ত কতজনকে ব্লাকমেল করেছেন এমন সব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মৌ।