সামরিক শাসনে বদলে গেছে মিসরের বিনোদন জগৎ
সামরিক শাসনে বদলে গেছে মিসরের বিনোদন জগৎ।মিসরের টিভি ও সিনেমা শিল্প দীর্ঘকাল আরব বিশ্বের ঈর্ষার কারণ ছিল। বিংশ শতাব্দীতে মিসরের সিনেমাগুলো ছিল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম মাধ্যম। রাবাত থেকে বাগদাদ পর্যন্ত আরবেরা মিসরের নিজস্ব উপায়ে বানানো জনপ্রিয় মিউজিক্যাল এবং কৌতুকের বুলি নকল করতে শিখেছিল। পরে এই চলচ্চিত্র বাণিজ্য মিসরকে সাংস্কৃতিক প্রভাব খাটাতে সাহায্য করে। এমনকি মিসরের শাসক সমাজও সিনেমা শিল্পকে নিজেদের প্রচারের মাধ্যম হিসেব ব্যবহার করে আসছে। ১৯৩০–এর দশকে যখন মিসরের চলচ্চিত্রগুলো জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল, তখন রাজা আহমেদ ফুয়াদ পাশা এসব চলচ্চিত্রে নিজের খবর প্রচার করতেন।
মিসরকে বলা হতো মধ্যপ্রাচ্যের ‘হলিউড’। সিনেমা, নাটক থেকে শুরু করে নানা দিক থেকেই বিনোদন জগতে ছড়ি ঘোরাত দেশটি। কিন্তু এখন দৃশ্যটি একেবারে আলাদা। না, করোনাই একমাত্র কারণ নয়। মিসরের বিনোদন জগতে এখন যে মন্দা দশা চলছে, তার কারণ সামরিক শাসন। মিসরের বিভিন্ন টিভি সিরিয়াল ও সিনেমায় এখন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বীরত্বগাথাই শুধু প্রচার করা হয়। ঠিক যেমন তুর্কি সিরিয়ালে প্রচার করা হয় পুরোনো দিনের শৌর্যবীর্যের কথা। রাষ্ট্র সেখানে প্রচ্ছন্ন থাকে। ঐতিহাসিক বিভিন্ন চরিত্রের আড়ালে মুখ লুকিয়ে তারা বর্তমান তুরস্কের শৌর্যকে তুলে ধরে।
মিসরেও এখন তুর্কি বিভিন্ন সিরিয়াল বেশ জনপ্রিয়, ঠিক যেমন জনপ্রিয় বাংলাদেশে। এটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রকাঠামোগুলোর একটি গোপন সমঝোতা বলা যায়, যা সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিনিময়ের মাধ্যমে একটি আরেকটির পিঠ বাঁচিয়ে চলে। তারও আগে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসা জামাল আবদেল নাসের পরে সে সময়ের সিনেমাগুলোকে মিসরের রাজতন্ত্র প্রচারের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত করেন। একই সঙ্গে সেই সব সিনেমা তিনি বর্জনও করেন। কিন্তু মিসরের চলচ্চিত্র শিল্পের ভাগ্য বদলায়নি। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব সেখানে আবার ফিরে এসেছে। এমনিতে যেকোনো দেশের সিনেমা বা নাটকের ওপর সে দেশের সরকারের একটা প্রভাব থাকে। রাষ্ট্র চায়, তার বয়ান সৃষ্টিশীল এসব মাধ্যমে প্রচার হোক। কিন্তু সমস্যা হয় তখনই, যখন রাষ্ট্রীয় বয়ান প্রচারই সৃষ্টিশীল এসব মাধ্যমের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। একটা বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হয় সৃষ্টিশীল মানুষদের পায়ে। মিসরও এখন এখন এই সংকটের মধ্য দিয়েই যাচ্ছে। মিসরে এই সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি শো ‘দ্য চয়েস’। কী আছে এতে? পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর বীরত্বগাথাই এর মূল উপজীব্য। এরই মধ্যে প্রথম সিজন দিয়ে বেশ সাড়া ফেলেছে মিসরের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা পরিচালিত অনুষ্ঠানটি। এতে সরাসরি সহায়তা দিচ্ছে সরকার।
হাশমি আশমায়ি মিসরের মোস্ট ওয়ান্টেড লোক, যিনি সেনা কর্মকর্তা থেকে জিহাদি হয়েছিলেন। ২০২০ সালে মার্চে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এর দু মাস পর তাঁকে আবার ফাঁসি দেওয়া হয়। কীভাবে? এবার টিভি শোতে, যার নাম ‘দ্য চয়েস’। হাশমির চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলা অভিনেতা এবার ওঠেন প্রতীকী ফাঁসিকাঠে। একই সময়ে সত্যিকারের ফাঁসির দৃশ্য ধারণ করা ভিডিওটি ফাঁস করা হয়। কে করেছে? রাষ্ট্রীয় বাহিনী।
গত কয়েক বছর ধরেই মুদ্রাস্ফীতির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে দেশটি। এ অবস্থায় বিনোদন খাত বাজেট ঘাটতিতে ভুগছে। এর মধ্যে যখন সেন্সরশিপের বাড়বাড়ন্ত ও সরকারি কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ হয়, আর সেনাবাহিনী নিজেই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান খুলে ব্যবসা শুরু করে, তখন নির্মাতা ও প্রযোজকদের প্রমাদ গুনতে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা পরিস্থিতি। সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশটির বিনোদন জগৎ। বোঝাই যাচ্ছে মিসরের আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি সরকার কত সরাসরি বিনোদন জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর মতো মিসরেও আগে থেকে সেন্সরশিপ ছিল। দারিদ্র্য, দেশের অভ্যন্তরীণ দুরবস্থা, সরকারের কঠোর সমালোচনা ইত্যাদি সিনেমা বা নাটকের মাধ্যমে তুলে ধরাটা কঠিন ছিল। কিন্তু সিসির আমলে এই নিয়ন্ত্রণ সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সেন্সরশিপ আগের চেয়ে আরও কঠোর হয়েছে।
বিনোদন শিল্পের জন্য নানা জটিল–কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু যখন সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ সংযোগে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে, আর টেলিভিশনের সোপ অপেরাগুলোর একমাত্র নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে তারাই, তখন তা অতীতের সবকিছুকেই ছাড়িয়ে যায়। এটি এখন গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। সিনেমা শিল্পও টেলিভিশনের মতো একই ভাগ্য বরণ করে কিনা, এখন সে আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রযোজনা সংস্থাটি কী করছে? ইজিপশিয়ান মিডিয়া কোম্পানি (ইএমসি) ২০১৮ সালে একগাদা নতুন নীতির প্রবর্তন করে। এই নতুন নীতিমালার কারণে তাদের অঙ্গসংস্থা সিনার্জি ছাড়া আর কারও পক্ষে টেলিভিশনের জন্য মেগা সিরিয়াল বা সোপ অপেরা তৈরি প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। নতুন সে নীতিমালায় প্রযোজনা ব্যয়ের খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা হয়, শুটিংয়ের সময় ১২ সপ্তাহের মধ্যে সীমিত করা হয় এবং নাটক নির্মাণের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেওয়া হয়। এই নীতিমালা অবশ্য শুধু রমজান মাসের জন্য কার্যকর। চলতি বছর ৬ মে থেকে ৪ জুন পর্যন্ত এই নীতিমালা মেনে চলতে হয়েছে সবাইকে। আর এটিই টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পথে বসিয়ে দিচ্ছে। কারণ মিসরে রমজান মাসেই মানুষ এসব নাটক বেশি দেখে। পবিত্র মাসকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় বহু অনুষ্ঠান। ফলে বাড়ে বিজ্ঞাপনী আয়। কিন্তু নতুন এই নীতির কারণে এক সিনার্জি ছাড়া আর কেউ ঠিক সুবিধা করতে পারছে না।
সিনার্জি পারছে, কারণ তাদের পেছনে রয়েছে রাষ্ট্র। আগেই বলা হয়েছে মিসর সর্বদা সেন্সরশিপের অধীনে ছিল। তবুও ১৯৮১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের অধীনে তারা বেশ ভালো নাটক–সিনেমা তৈরি করেছে। সে সময় পুলিশ বা রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি থেকে শুরু করে সমকামিতা নিয়ে নানা তর্ক উপস্থাপনের সুযোগ ছিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। এসবের চিত্রায়ণ ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এখন এমন কিছু ভাবাটাও কঠিন হয়ে পড়েছে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল জনগণ। তার ভিতটি কিন্তু রচিত হয়েছিল প্রশাসনিক ও আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা দুর্নীতির কেচ্ছা প্রচারের মাধ্যমেই। এখন সেই পথটিকেই রুদ্ধ করতে চাইছে সিসি সরকার।
মিসরের সংবাদমাধ্যম আল–শুরুক এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলী মুরাদকে উদ্ধৃত করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক রাজনীতি ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ওপেন ডেমোক্রেসি জানিয়েছে, মিসরের টিভি চ্যানেল ও সিনেমাগুলো এখন বিশেষ কিছু মতবাদ প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এর বাইরে কিছুই প্রচার করা যায় না। রাষ্ট্রই ঠিক করে দেয়, কী বলা যাবে, আর যাবে না। আলী মুরাদ বলেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট নাসেরের সময় থেকে এই সময়ের আগ পর্যন্ত এমন ধারা আমরা আর দেখিনি।