আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রে চিকিৎসক ঈশিতা

আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রে চিকিৎসক ঈশিতা।রাজধানীর মিরপুর থেকে এক নারী প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। তার নাম-ইশরাত রফিক ঈশিতা। রবিবার (১ আগস্ট) তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি বাংলা ম্যাগাজিনকে নিশ্চিত করেছেন র‍্যাব লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।তিনি বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং দেশি ও বিদেশি সংস্থার ভূয়া প্রতিনিধি পরিচয়ে প্রতারণার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কথিত তরুণ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক ওরফে বিশিষ্ট আলোচক ওরফে ডিপ্লোম্যাট ওরফে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল ওরফে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নানান পরিচয়ে প্রতারণা করে আসছিল সে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ইশরাত রফিক ঈশিতাকে সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ইসরাত রফিক ঈশিতা (৩৪)। ২০১৩ সালে ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। এরপর মিরপুরের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চাকরি করার সময় শৃঙ্খলাজনিত কারণে তিনি চাকরিচ্যুত হন। এরপর আর কোনো হাসপাতালে তিনি চাকরিতে যোগদান করেননি। ছুটে চলেন খ্যাতির পেছনে। খ্যাতি অর্জন করতে গিয়ে তিনি তার নামের পেছনে দিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। আবার বাসার সামনের একটি সাদা কালো সাইন বোর্ডে নাম দিয়েছেন কর্নেল ডা. ঈশিতা। নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন ১৬টি ভুয়া ডিগ্রি।

তার শৈশবের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে ময়মনসিংহ জেলায়। বাবা খন্দকার রফিকুল ইসলাম সিনিয়র ফ্যাকাল্টি মেম্বার, বিকেবি এবং মা হেলেন রফিক, এমএমসি ঢাকা ইউনিভার্সিটি। একমাত্র বড় বোন এমআইটি বোস্টন আমেরিকাতে পিএইচডি করছেন। ডা. ঈশিতা ২০০৮ সালে বিদ্যাময়ী গভর্মেন্ট গার্লস হাই স্কুল ময়মনসিংহ থেকে এসএসসি পাস করেন। ২০১০ সালে মমিনুন্নেসা গভমেন্ট গার্লস কলেজ ময়মনসিংহ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজে এমবিবিএসে ভর্তি হন তিনি। ২০১৬ সালে এমবিবিএস পাস করেন ঈশিতা। ২০১৮ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) থেকে এমপিএইচ ডিগ্রি অর্জন করেন।

এইসব পদবি ভাঙিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনি সক্রিয় হন। পাশাপাশি তিনি টকশোতেও ছিলেন সরব। করোনা মহামারিতে তিনি ৬০ জনকে ভুয়া করোনা নেগেটিভ এর সনদ দিয়ে প্রত্যেক জনের কাছ থেকে ৪ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন। র‌্যাবের মাঠ পর্যায়ের গোয়েন্দারা জানতে পারেন যে, তিনি শুধু দেশীয় নয়, আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের এক সদস্য। তাকে আজ সকাল ৯টার দিকে র‌্যাব শাহআলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় তার কাছ থেকে ভুয়া আইডি কার্ড, ভিজিটিং কার্ড, সিল, সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, ৩০০ পিস ইয়াবা ও পাঁচ বোতল বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়। ঈশিতার সঙ্গে তার অপকর্মের সহযোগী শহীদুল ইসলাম দিদারকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল বিকালে রাজধানীর কাওরান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানা যায়। 

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, চিকিৎসক ইশরাত রফিক ঈশিতা ফিলিপাইনের একটি ওয়েবসাইট থেকে ৪০০ ডলারে সামরিক বাহিনীর মতো ‘ব্রিগেডিয়ার জেনারেল’ র‌্যাঙ্ক পদটি কিনেছিল। এরপর সেই র‌্যাঙ্ক ব্যাজ ও পোশাক বানিয়েছিলেন। তার সহযোগী শহিদুল ইসলাম দিদারও ফিলিপাইনের প্রতিষ্ঠানটি থেকে ‘মেজর জেনারেল র‌্যাঙ্ক’ পদ কিনেছিলেন। পরে জানা যায় যে, ফিলিপাইনের যে ওয়েবসাইট থেকে যে পদবি দেয়া হয় সেটি আসলে ভুয়া।তিনি আরও জানান, ঈশিতা ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশনের সদস্য পদের ভুয়া সনদ তৈরি করে প্রচারণা চালিয়ে থাকেন। ভুয়া ডিগ্রি, পদ-পদবি ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও আইপি চ্যানেলে নিজের প্রচার-প্রচারণা চালাতেন। তাছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে টকশোতে অংশগ্রহণ করতেন। বিশেষ করে ভুয়া সার্টিফিকেট, এডিটিং ছবি, মিথ্যা বিবৃতি ও তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সবাইকে বিভ্রান্ত করতেন। এ ছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারী শিশু অধিকার, চিকিৎসা বিজ্ঞান, করোনা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচক হিসেবে নিজের প্রচার চালাচ্ছিলেন।

যেখানে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। ভুয়া অ্যাওয়ার্ডের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ঈশিতা ও তার প্রধান সহযোগী দিদার ভাগ করে নিতেন। ২০১৯ সালে রাজধানীর একটি অডিটোরিয়ামে ৩০ ইয়াং লিডারকে সম্মাননা জানানো হয়। অনুষ্ঠানে ঈশিতা সঞ্চালক ছিলেন। অনুষ্ঠানটি গ্রহণযোগ্য করতে বিভিন্ন ব্যক্তিদের ছবি যুক্ত করে অ্যাডভাইজার, ভাইস চেয়ারম্যান, ইন্টারন্যাশনাল ভাইস চেয়ারম্যানসহ নানা পদে দায়িত্ব পালন করতো বলে প্রচারণা চালাতেন।’এছাড়া তিনি অ্যাম্বাসেডর হিসেবে বিভিন্ন সংগঠন যথাক্রমে আমেরিকান সেক্সুয়াল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল সার্ভিকাল ক্যান্সার কোয়ালিশন এবং গ্লোবাল গুডউইল ইত্যাদি হিসেবে বাংলাদেশে কাজ করছেন। তিনি অ্যাওয়ার্ড বিষয়ক অনুষ্ঠানে উপস্থিতির এডিটিং করা ভুয়া ছবি ও সনদ তৈরী করে গণমাধ্যমে প্রেরণ ও ভার্চুয়াল জগতে প্রচারণা করতেন।

র‌্যাবের মুখপাত্র আরও জানান, ঈশিতার বস হিসেবে পরিচয় দেয়া তার সহযোগী শহিদুল ইসলাম দিদার ২০১২ সালে ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা (ইঞ্জিনিয়ার) শেষ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমা করেছেন। তিনি একটি গার্মেন্টে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। দিদারও ফিলিপাইনে একই সাইট থেকে টাকার বিনিময়ে ‘মেজর জেনারেল’ পদ কেনেন। এ ছাড়াও নিজেকে আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক), ইয়াং ওয়ার্ল্ড লিডার ফর হিউম্যানিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বা কর্ণধার হিসেবে পরিচয় দিতেন। একইভাবে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দূত বা অ্যাম্বাসেডর পরিচয় দিতেন। 

তিনি আরও জানান, এভাবে দেশে ও বিদেশে প্রতারণা, চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থ কামিয়েছেন। চিকিৎসক হয়েও তার এই প্রতারণার কারণ কী-সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, তার এই প্রতারণার কারণ হচ্ছে নিজেকে সবার কাছে বড় সুপার স্টার হিসেবে পরিচিতি করানো। এ ছাড়াও বিপুল পরিমাণের অর্থ আয় করা তার প্রধান লক্ষ্য ছিল। তাকে কারা পেছন থেকে মদত দিয়েছে অন্য প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি যে কারা তাকে মদত দিয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক মো. মোজাম্মেল হক, র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম বিভাগের পরিচালক মেজর রইসুল আজম মনি ও সহকারী পরিচালক এএসপি ইমরান হোসেন ইমন প্রমুখ।

Exit mobile version