স্থবির চাকরির বাজার, হতাশায় দেশের তরুন যুবক শ্রেণী

স্থবির চাকরির বাজার, হতাশায় দেশের তরুন যুবক শ্রেণী।করোনার মহামারীর সংক্রমণ কমাতে দেওয়া একের পর এক লকডাউনে কঠিন সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাত। নতুন নিয়োগ তো দূরে, টিকে থাকতে অনেক প্রতিষ্ঠানই কর্মী ছাঁটাইয়ের পথ বেছে নিচ্ছে। সব মিলিয়ে ভয়াবহ মন্দার মুখে পড়েছে চাকরির বাজার।দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে করোনা মহামারী চলছে। বিশ্বজুড়ে বিপর্যস্ত অর্থনীতি। বন্ধ অনেক শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা-বাণিজ্য। সরকারি ছাড়া কয়েক বছর ধরে দেশে কোনো ধরনের বিনিয়োগ নেই। মহামারীতে থমকে গেছে শ্রমবাজার। চাকরি হারিয়ে বাড়ছে নতুন বেকারত্ব। অন্যদিকে, সরকারি ও বেসরকারি খাতে দীর্ঘসময় ধরে নেই নতুন করে কোনো নিয়োগ। সব মিলিয়ে নতুন করে বেকারত্ব বাড়ছে প্রতি বছর। বয়স তো থেমে থাকছে না, এ অবস্থায় হতাশায় ভুগছে যুবসমাজ।

করোনা মহামারীর প্রথম বছরেই চাকরি কমেছিল ২৯ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই তা কমে গেছে ২৮ শতাংশ। বছর শেষে তা ৫০ শতাংশ ছাড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। চাকরি কমার পাশাপাশি অনেকের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। এতে হতাশাগ্রস্ত তরুণদের অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ বিভিন্ন অপরাধেও জড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।দেশের শ্রমবাজারে বছরে প্রায় ১০ লাখের মতো নতুন শ্রমশক্তির অন্তর্ভুক্তি হচ্ছে। আর দেশে যে পরিমাণ চাকরির সুযোগ আছে, তাতে প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৪৭ শতাংশ গ্র্যাজুয়েটের চাকরি পাওয়ার সুযোগ নেই বলে শ্রমবাজারে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, এখন প্রয়োজন ধাপে ধাপে অনলাইনে চাকরির পরীক্ষার ব্যবস্থা করা। আর সরকারের উচিত হবে আগামী দিনে আন-এমপ্লয়মেন্ট বীমার চিন্তা-ভাবনা করা।

সর্বশেষ ২০১৭ সালের বিবিএস শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী, দেশে ২৭ লাখ মানুষ কোনো কাজ করে না। অর্থাৎ এরা বেকার। শতাংশ হিসাবে বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া এ বছরের ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত গত ২০২০ সালের এইচএসসি ও সমমানের মূল্যায়নে সারা দেশে ১১টি শিক্ষা বোর্ড থেকে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন শিক্ষার্থী পাস করেছে। এর আগের বছর ২০১৯ সালে মোট ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন শিক্ষার্থী এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন পাস করেছে। অর্থাৎ দেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখের মতো জনশক্তি নতুন করে যুক্ত হচ্ছে। বিবিএস সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ এর হিসাব বলছে, দেশে শ্রমশক্তির মোট পরিমাণ পাঁচ কোটি ৬৭ লাখ। এর মধ্যে কাজ করছে পাঁচ কোটি ৫১ লাখ ৮০ হাজার জন। এর অর্থ বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৮০ হাজার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘আমরা একটি কঠিন সময় পার করছি। ঘরবন্দি মানুষের কোনো সামাজিকতা নেই। এতে মানুষের মনে ব্যাপক চাপ পড়ছে। বেকারত্ব, আয় কমে গেলে মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মানসিক ডিপ্রেশন, সাইকোপ্যাথ, এলিয়েনেশন কাজ করবে, স্পৃহা হারিয়ে গেলে মানুষ কোনো না কোনোভাবে নেতিবাচক কাজ করবে। তাই বেকারদের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’

এদিকে, পিএসসি করোনা মহামারীতে সবধরনের পরীক্ষা ও নিয়োগ বন্ধ রেখেছে। সর্বশেষ ১২ এপ্রিল সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নন-ক্যাডার চাকরির আবেদন কার্যক্রমও স্থগিত করেছে সরকারি কর্মকমিশন। এছাড়া গত ৩১ মার্চ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ১০ গ্রেডের সিনিয়র স্টাফ নার্স ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের ফটো টেকনিশিয়ান পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। করোনাকালে নতুন করে ব্যাপক বেকারত্ব বৃদ্ধিতে একটা উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে। এর মধ্যে সরকারি চাকরির নিয়োগ ও নির্বাচনী পরীক্ষা স্থগিত হয়ে থাকায় তরুণ প্রজন্মের জন্য বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগপ্রক্রিয়া স্থবির হয়ে থাকায় অনেক চাকরিপ্রার্থী তরুণ-তরুণীরই বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে।

দেশের চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশের শীর্ষ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বিডিজবস ডট কমের তথ্য অনুযায়ী, প্ল্যাটফর্মটিতে ২০১৯ সালে ৬৩ হাজার ৬০৮টি চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। করোনার বছর ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ২০৮টিতে। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে ২৯ শতাংশ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিডিজবসে চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে ৩২ হাজার ৭২১টি। ২০২০ সালের তুলনায় চলতি বছরের ছয় মাসে কমেছে ২৮ শতাংশ, যা বছর শেষে ৫০ শতাংশ ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানো, হস্তশিল্প, কারখানার চাকরি, দরজির কাজ এবং হালকা প্রকৌশলের মতো ক্ষেত্রে সাধারণত তরুণীদের কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু এই খাতগুলোই মহামারীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। খাতগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন ও সময়সাপেক্ষ, তাই করোনাকাল শেষেও তরুণীদের জন্য চাকরিতে ফিরে আসতে অসুবিধা হবে।

বেসরকারী চাকরির পাশাপাশি সরকারি চাকরিতেও নিয়োগ কমে গেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। এসবের বিপরীতে ১৫ লাখ চার হাজার ৯১৩ জন বর্তমানে কর্মরত। শূন্য আছে তিন লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮টি পদ। বর্তমানে শূন্যপদের মধ্যে ৪৬ হাজার ৬০৩টি প্রথম শ্রেণির, ৩৯ হাজার ২৮টি দ্বিতীয় শ্রেণির, এক লাখ ৯৫ হাজার ৯০২টি তৃতীয় শ্রেণির এবং ৯৯ হাজার ৪২২টি চতুর্থ শ্রেণির।

Exit mobile version