দেশের আর্থিক খাতে কৌশলে লুটপাট চালিয়েছে পিকে হালদার । এ কাজে সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তত্কালীন পরিচালকদের প্রশ্রয়ও পেয়েছেন তিনি। পিকে হালদার এ পর্যন্ত নানা কৌশলে জালিয়াতির মাধ্যমে ঠিক কী পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, সে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার হয়নি। এ নিয়ে এখনো অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক। অনুসন্ধানে জালিয়াতির বিভিন্ন কৌশলসহ তার বিষয়ে আরো অনেক তথ্যই এখন বেরিয়ে আসছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই পিকের ৩০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের প্রচ্ছন্ন সহায়তারও প্রমাণ মিলেছে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে কোনো মর্টগেজ ছাড়াই ঋণ দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
দুদক সূত্রে জানা গিয়েছে, ভুয়া-কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পিকে হালদারসহ আরো প্রায় ৭৫ জনের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন। এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) তত্কালীন চেয়ারম্যানসহ সব পরিচালককেও এ মামলার আসামি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে দুদকের কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে। অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অনুসন্ধান প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে আরো মামলা করা হবে। এছাড়া অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে যাদের সম্পৃক্ততা মিলবে, তাদের বিরুদ্ধেই দুদকের বিধি ও আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, পিকে হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্স থেকে ৩০টি কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করেছেন। এ ঋণ জালিয়াতিতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যান-পরিচালকদের কাছ থেকে প্রচ্ছন্ন সহায়তা পেয়েছেন তিনি। কমিশনের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বলছে, আরবি এন্টারপ্রাইজ, জিঅ্যান্ডজি এন্টারপ্রাইজ, তামিম অ্যান্ড তালহা এন্টারপ্রাইজ, ক্রসরোড করপোরেশন, মেরিন ট্রাস্ট, নিউটেক, এমএসটি মেরিন, গ্রিনলাইন ডেভেলপমেন্ট, মেসার্স বর্ণসহ ইত্যাদি নামের অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে এসব ঋণ নেয়া হয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঋণের মূল সুবিধাভোগী ছিলেন পিকে হালদার।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, কাগুজে-ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে জালিয়াতি করে নেয়া এসব ঋণের অর্থ নানা পর্যায় পেরিয়ে যোগ হতো পিকে হালদারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। এমনই এক অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান কনিকা এন্টারপ্রাইজ। ঋণ নেয়ার সময়ে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী হিসেবে নাম লেখা হয়েছে রাম প্রসাদ রায়ের। প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেয়া হয়েছে ঢাকার গুলশান এভিনিউ নর্থ বাণিজ্যিক এলাকার জাহেদ প্লাজার সপ্তম তলা। নির্মাণসামগ্রী সরবরাহকারী হিসেবে দাবীকৃত প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক সক্ষমতা নিয়ে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই চলতি মূলধন হিসেবে ৪৫ কোটি টাকা ঋণ দেয় এফএএস ফাইন্যান্স। প্রতিষ্ঠানটির নামে ঋণের আবেদন করা হয়েছিল ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর। এ ঋণ অনুমোদন পায় একই বছরের ১৩ ডিসেম্বর। ঋণের বিপরীতে ২০০ শতাংশ জমি, যার বাজারমূল্য দেখানো হয় ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রস্তাবিত জামানতের এ জমির মালিকও পিকে হালদার। ঋণের বিপরীতে কোনো আদায় না থাকলেও ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে তা নবায়ন করা হয়। এ ঋণ নবায়নে প্রচ্ছন্ন সহায়তা করেছেন এফএএস ফাইন্যান্সের চেয়ারম্যানসহ পরিচালকরা।
মুন এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী শংখ বেপারী। কনিকা এন্টারপ্রাইজের ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে যে ঠিকানা লেখা হয়েছিল, একই ঠিকানা দেয়া হয়েছে মুন এন্টারপ্রাইজের ক্ষেত্রেও—ঢাকার গুলশান এভিনিউ নর্থ বাণিজ্যিক এলাকার জাহেদ প্লাজার সপ্তম তলা। বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী আমদানি ও সরবরাহের ব্যবসার জন্য নতুন প্রতিষ্ঠান মুন এন্টারপ্রাইজকে ৩৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল এফএএস ফাইন্যান্স। ২০১৬ সালের ৬ মার্চ এ ঋণের আবেদন করা হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২২ মার্চ এ ঋণের অর্থ দেয়া হয়। ঋণের বিপরীতে কোনো আদায় না থাকলেও ২০১৮ সালে ঋণটি আবারো নবায়ন করা হয়। সে সময় ৩৫ কোটি টাকার ঋণের স্থিতি ছিল ৪৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
একইভাবে বর্ণ, আনান কেমিক্যাল, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, দেয়া শিপিং, এমটিবি মেরিন, লিপ্রো ইন্টারন্যাশনাল, কোলাসিন, মার্কো ট্রেড, সিগমা ক্যাপিটাল মানেজমেন্ট, আর্থস্কোপ, নিউট্রিক্যাল, আইমেক্সকো, গ্রিনলাইন ডেভেলপমেন্ট, প্যারামাউন্ট স্পিনিংসহ একাধিক নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্স থেকে ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করেন পিকে হালদার। দুদক বলছে, অনুসন্ধানে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস ফাইন্যান্সের এমডি ও পরিচালনা পর্ষদের যোগসাজশে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ঋণ নিয়ে তা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। প্রকৃত সুবিধাভোগী যাচাই করতে আরো অনুসন্ধান প্রয়োজন।
হাইকোর্ট এরই মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছের। এফএএস ফাইনান্সের বোর্ড পুনর্গঠন করে দিয়েছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। নতুন পর্ষদ খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধারের নানা ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পিকে হালদারের বিরুদ্ধে অন্তত চারটি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। নানা কৌশলে নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলে শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনে এসব কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ নেন। পিকে হালদারের অর্থ আত্মসাৎ ও তা পাচারের অভিযোগ এনে একাধিক মামলা করেছে দুদক। তাকে গ্রেফতারের জন্য এরই মধ্যে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিস জারি করা হয়েছে। এছাড়া তার মা লীলাবতী হালদারসহ একাধিকজনের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট।
শুধু জালিয়াতি বা অর্থ আত্মসাৎ করেই থেমে যাননি পিকে হালদার। আত্মসাত্কৃত অর্থে বিলাসী জীবন কাটিয়েছেন তিনি। জমি কিনেছেন। আবার সে অর্থের একটি অংশ পাচার করেছেন সিঙ্গাপুর, ভারত ও কানাডায়। এখন পর্যন্ত দুদকের অনুসন্ধানে তার বিরুদ্ধে ৪০০ কোটির বেশি টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া কানাডায় পিকে হালদারের শপিং কমপ্লেক্স, বিলাসবহুল বাড়িরও তথ্য পেয়েছে দুদক। দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানসহ চার সদস্যের একটি দল এ অনুসন্ধান কার্যক্রম চালায়।